ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

‘নার্সের অস্ত্রোপচারে’ মৃত্যু প্রসূতির, পালাল হাসপাতালের সবাই

‘নার্সের অস্ত্রোপচারে’ মৃত্যু প্রসূতির, পালাল হাসপাতালের সবাই

ছবি-সংগৃহীত

গাজীপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২৪ | ০২:২৩

‘হাসপাতালে সার্জন ছিল না। নেই গাইনি বিশেষজ্ঞও। অন্তঃসত্ত্বা ইয়াসমিন আক্তারকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান এক নার্স। তড়িঘড়ি করে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করা হয় সন্তান। কিন্তু সদ্যপ্রসূত ফুটফুটে ছেলের মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি হতভাগী ইয়াসমিনের। ওটিতে গলগল করে রক্ত ঝরতে থাকে তাঁর শরীর থেকে। কোনোভাবেই ওই নার্স তা বন্ধ করতে পারছিলেন না। এক পর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে যায় প্রসূতির দেহ। নিভে যায় প্রাণপ্রদীপ।’ রোববার মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার মাওনা চৌরাস্তা এলাকার লাইফ কেয়ার হাসপাতালে। নার্স দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ অস্ত্রোপচারের অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজন।

জানা গেছে, ত্রুটিপূর্ণ অস্ত্রোপচারে প্রসূতির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। মুহূর্তেই জড়ো হয় নিহতের আত্মীয়স্বজন ছাড়াও শত শত মানুষ। এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে তারা হাসপাতালে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। খবর পেয়ে ছুটে আসেন শ্রীপুর থানা পুলিশের সদস্যরা। তারা কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। নিহত ইয়াসমিন গাজীপুর সদর উপজেলার বানিয়ারচালা গ্রামের ব্যবসায়ী মো. আসাদুল্লাহর স্ত্রী। এ দম্পতির ইকরা মণি নামে ১০ বছরের একটি মেয়ে আছে। মায়ের লাশ ঘিরে মেয়েটির কান্নায় ভারি হয়ে যায় বাতাস। ইয়াসমিনের বাবার বাড়ি শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া এলাকায়। 

রোববার রাত ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, একটি অ্যাম্বুলেন্সে পড়ে ছিল ইয়াসমিনের প্রাণহীন দেহ। পাশেই আহাজারি করছিলেন স্বজন। কোলে চড়ে হাউমাউ করে কাঁদছিল ইয়াসমিনের প্রথম সন্তান ইকরা মণি। মেয়েটি বলছিল, ‘তোমরা আমার মাকে ক্ষমা কইরা দিও, আমার একটা ডাকে সাড়া দিতে কও মাকে। মা, মা, মাগো, আমারে এখন ক্যাডা বুকে নিয়া ঘুমাইবো? মা তুমি যাইয়ো না।’ তার এমন গগনবিদারী বিলাপে উপস্থিত সবার চোখ ভিজে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ইয়াসমিনের লাশ সরিয়ে ফেলার জন্য হাসপাতালের লোকজনই অ্যাম্বুলেন্স আনে। ততক্ষণে কর্তৃপক্ষের সবাই পালিয়ে গেছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন স্থানীয় জামাল হোসেন নামে এক সংবাদকর্মী। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের তিন তলায় উঠে দেখি, ছোট্ট একটি কক্ষে সদ্যপ্রসূত শিশু বিছানায় পড়ে আছে। শরীরজুড়ে রক্ত। ছটফট করছে। কেউ নেই তার সঙ্গে। প্রথমে শিশুটিকে কোলে নিই। তার পর দ্রুত তাকে অন্য একটি হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করি। নবজাতক ভালো আছে।’

নির্মম এ ঘটনার খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালে ছুটে আসেন শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শোভন রাংসা। এ সময় তিনি বলেন, এ ঘটনার তদন্ত হবে। নিহতের স্বজন যেন শ্রীপুর থানায় মামলা করেন।

নিহতের মা রাজিয়া আক্তার জানান, রোববার দুপুর ১২টায় ইয়াসমিনকে ওই হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসক না থাকায় ইফতারের পর অস্ত্রোপচার করা হবে বলে জানানো হয়। এ সময় স্বজন সবাই চলে যান। তবে তিনি হাসপাতালের কেবিনের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন। হঠাৎ বিকেল ৫টার দিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানায়, ইয়াসমিন ছেলে সন্তান জন্ম দিয়েছে। তাৎক্ষণিক কেবিনের ভেতরে গিয়ে দেখেন, তার মেয়ের নিথর দেহ পড়ে আছে। শরীর থেকে প্রচুর রক্ত ঝরছে। বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা তড়িঘড়ি করে প্রাণহীন ইয়াসমিনকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়। এরই ফাঁকে পালিয়ে যায় হাসপাতালের সবাই।   

লাইফ কেয়ার হাসপাতালের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. রাসেল মোবাইল ফোনে বলেন, বিষয়টি রাতেই মীমাংসা হয়েছে। হাসপাতালে থাকা অন্য সব রোগীকে আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

হাসপাতালের মালিক আজহারুল ইসলাম পারভেজ বলেন, নার্স দিয়ে অস্ত্রোপচার করা হয়নি। সার্জন মৌসুমি আক্তার লিজা অস্ত্রোপচারটি করেছেন। আর অ্যানেসথেশিয়ার চিকিৎসক ছিলেন ডা. শরীফ। অপারেশন সফল হলেও হঠাৎ প্রসূতির রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটে।

মীমাংসার বিষয়ে জানতে প্রসূতির স্বামী আসাদুল্লাহর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি কোনো জবাব দেননি। তবে শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রণয় ভূষণ দাস বলেন, নার্সের মাধ্যমে অস্ত্রোপচার এবং ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যুর অভিযোগ তদন্ত করা হবে। এর আগেও এ হাসপাতালের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।

শ্রীপুর থানার ওসি আকবর আলী খান বলেন, এ ঘটনায় থানায় কেউ মামলা করেনি কিংবা অভিযোগও দেয়নি।

আরও পড়ুন

×