ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

লালমাই পাহাড় কাটছে কুবি কর্তৃপক্ষ

লালমাই পাহাড় কাটছে কুবি কর্তৃপক্ষ

যে যেভাবে পারছে দখল করে নিচ্ছে লালমাই পাহাড়ের জমি। বাদ যায়নি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও সমকাল

 কামাল উদ্দিন, কুমিল্লা 

প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৪ | ০০:৫৬

সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিনোদন পার্ক তৈরি, এমনকি রাস্তা সম্প্রসারণেও কাটা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী লালমাই-ময়নামতি পাহাড়। রাতের আঁধারে বিক্রি হচ্ছে এর মাটি। পাহাড় দখল করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে সাইনবোর্ড। তবে লালমাই-ময়নামতি পাহাড় বেশি কাটছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) কর্তৃপক্ষ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই কুবির সম্প্রসারিত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অন্তত ১০০ একর পাহাড় কেটে ভবন তৈরির কাজ চলছে। 
স্থানীয়রা বলছেন, মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে পাহাড় কাটা শ্রমিকদের পাকড়াও করা হলেও আসল দখলদার থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। 
লালমাই-ময়নামতি পাহাড় উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১১ মাইল লম্বা, পূর্ব-পশ্চিমে চওড়া প্রায় ২ মাইল। এই পাহাড়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা ৪৬ মিটার। পাহাড়ের অধিকাংশ অংশ কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায় পড়েছে, আর কিছু অংশ জেলার আদর্শ সদর ও বুড়িচং উপজেলায়।

প্রত্নসম্পদে ভরা লালমাই-ময়নামতি পাহাড় কাটার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদরা। তারা বলছেন, পাহাড় কাটার ফলে প্রত্নসম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য বিপন্ন হচ্ছে গুরুতরভাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারিত প্রকল্পের জন্য প্রায় ২০০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৩১ একর পাহাড় ও টিলা। লালমাই মৌজার রাজারখলায় টিলা কেটে কুবির স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। টিলাটি কাটা হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই। এর আগে, ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে শর্তসাপেক্ষে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায় কুবি। কিন্তু ‘পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণের’ বিস্তারিত তথ্য না দেওয়ায় পর আটকে যায় সেই অনুমতি। এর পর আবারও অনুমতি চেয়ে আবেদন করে কুবি কর্তৃপক্ষ। সেই ফাইল আটকে আছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে।

পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক মোসাব্বের হোসেন মোহাম্মদ রাজীব সমকালকে বলেন, ‘২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর কুবির পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. শফিকুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য পাহাড় কাটার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। পরে সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কখন অনুমতি মিলবে, কিংবা আদৌ মিলবে কিনা আমাদের জানা নেই। এটুকু বলা যায়, বর্তমানে কুবি কর্তৃপক্ষ অনুমতি ছাড়াই পাহাড় কাটছে।’

এই কথা মেনে নিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারিত ক্যাম্পাস-২ প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী এস এম শহিদুল হাসান বলেন, ‘মাত্র ৩ মাস হলো এ পদে যোগদান করেছি। শিগগিরই মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগ করে অনুমতি পাওয়ার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেব।’

২০২৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ককে পাহাড় কাটা বন্ধের নির্দেশ দেন। তার পরও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণ প্রকল্পের জন্য পাহাড় কাটা বন্ধ হয়নি।

সরেজমিন দেখা যায়, কোটবাড়ী জাদুঘর থেকে পশ্চিমের সড়কে ‘কাশবন’ নামে একটি রিসোর্ট ও একটি পার্ক তৈরি হয়েছে পাহাড় কেটে। বিনোদন পার্ক ‘ব্লু ওয়াটার’, ‘ডাইনোসর’ ও ‘ম্যাজিক প্যারাডাইস’ গড়ে উঠেছে পাহাড় ক্ষত-বিক্ষত করে। বেসরকারি সিসিএন বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা ফিজিক্যাল কলেজ ও ব্যক্তিমালিকানার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানও হয়েছে লালমাটির পাহাড় কেটে। পাহাড়ের মাটি লুটের চিত্র দেখা যায় সদর দক্ষিণের ধর্মপুর-কোটবাড়ী সড়কের বিজয়পুর ইউনিয়নের শ্রীবিদ্যা, জামমুড়া, লালমাই, বিজয়পুর, হরষপুর রাজারখোলা, গলাচিপা, সালমানপুর, কোটবাড়ী, সানন্দা, রাঙ্গামুড়া, ষাইট কলোনি, বড়বাতুয়া, ভাঙ্গামুড়া, চৌধুরীখোলা, ধনমুড়া, হাতিগাড়া, রানী ময়নামতি প্রাসাদের পাশে, চণ্ডীপুর, রতনপুর, বড় ধর্মপুর ও উত্তর লক্ষ্মীপুরে। পাহাড় গুঁড়িয়ে দিয়ে এসব এলাকা সমতল বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
সিসিএন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ড. মো. তরিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘২০০৮ সালে পাহাড়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন তৈরি শুরু হয়। কিন্তু এ জন্য কোনো পাহাড় কাটা হয়নি।’ এ ব্যাপারে কি পরিবেশ অধিদপ্তেরর অনুমতি ছিল–এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সেটি নেওয়া হয়নি, তবে উপজেলা পরিষদের অনুমতি নেওয়া হয়েছে।’

সম্প্রতি সদর দক্ষিণের বড় ধর্মপুর এলাকায় মজুমদার চা বাগানের পশ্চিমপাশে বিশাল পাহাড় কাটা শুরু করেছে মাটি ব্যবসায়ী একটি চক্র। রাতের আঁধারে এখানকার মাটি ট্রাক্টরে করে অন্যত্র নেওয়া হচ্ছে। লালমাই পাহাড়ের সালমানপুরেও কাটা হচ্ছে ৩০ শতাংশের একটি টিলা।। এ ছাড়া পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে মালিকানা দাবি করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে সাইনবোর্ড। সিসিএন বিশ্ববিদ্যালয় সড়কে এমন তিনটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ে।  

লালমাই পাহাড়ের একটি বিশাল অংশ পড়েছে সদর দক্ষিণ উপজেলায়। এই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রুবাইয়া খানম বলেন, ‘রাতের আঁধারে কেউ কেউ পাহাড় কাটছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ধরা পড়লে তাদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।’ পাহাড়ের বেশ কিছু অংশ বন বিভাগের জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বন বিভাগ পাহাড় কাটা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তারা চাইলে সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, কুমিল্লা শাখার সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন বলেন, ‘শুধু সরকারি নয়, ব্যক্তিমালিকানার পাহাড়ও বিনা অনুমতিতে কাটা দণ্ডনীয় অপরাধ। পাহাড় কাটা ঠেকাতে পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে। জড়িতরা প্রভাবশালী হলেও তাদের আইনের মুখোমুখি করতে হবে।’

 

আরও পড়ুন

×