ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ বাঁশকোড়লই ভরসা

থানচির দুর্গম এলাকায় দেড় শতাধিক পরিবারে খাদ্য সংকট

ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ বাঁশকোড়লই ভরসা

নিজ বাড়িতে একটি ম্রো পরিবারের কয়েকজন। বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুর্গম মেনহাত ম্রো পাড়ায়

উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা, থানচি থেকে ফিরে

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২০:২৭ | আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২১:১৮

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমানা ঘেঁষে অবস্থান পানঝিড়ি পাড়ার। এখানে বসবাস করে ১৮টি ম্রো পরিবার। তাদের মধ্যে ১৩টিই ভুগছে খাদ্য সংকটে। এই পাড়ার মেনদু ম্রোর (৩১) পরিবারে রয়েছে আটজন সদস্য। প্রতি বেলায় আড়াই কেজি চাল প্রয়োজন হয়। কয়েক সপ্তাহ ধরেই সেই চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না তারা। একই অবস্থায় পড়েছে বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুর্গম এলাকায় দেড় শতাধিক পরিবারের কয়েকশ মানুষ। তারা বলছেন, গত বছর ভারী বর্ষণের কারণে সৃষ্ট বন্যায় বহু পাহাড় ধসে পড়ে। নষ্ট হয় জুমের ফসল। এই ফসলের ওপরই তারা সারাবছর নির্ভরশীল। গত বন্যার প্রভাবে এবার ভুগছেন তারা।

পানঝিড়ি পাড়া পড়েছে রেমাক্রি ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। ৮ সেপ্টেম্বর ওই পাড়ায় গিয়ে পরিবারগুলোর দুর্দশার চিত্র দেখা যায়। এই পাড়ার মেনচিং ম্রোর (৩৫) পরিবারে সদস্য সাতজন। প্রতি বেলায় চাল লাগে আড়াই কেজি। বুলং ম্রোর (৪২) ৯ সদস্যের সংসারে বেলায় লাগে চার কেজি চাল। সম্প্রতি এসব পরিবার ম্রো স্টুডেন্ট কাউন্সিলের পক্ষ থেকে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। সঙ্গে নাপ্পি, ডাল ও তেলও পেয়েছিলেন। এসব উপকরণ দিয়ে কয়েকদিন কষ্ট করে সংসার চালিয়েছেন পেশায় জুমচাষি এসব পরিবার। তারা জানান, সরকার বা অন্য কোনো সংস্থা থেকে আর সহায়তা মেলেনি। কোনো কোনো পরিবার তিন বেলার বদলে দুই বেলা বা এক বেলা ভাত খাচ্ছেন। চালের পরিমাণ কমিয়ে সঙ্গে তাদের মেশাতে হচ্ছে বাঁশকোড়ল। আগামী জুমে ধান না ওঠা পর্যন্ত এ দুর্ভোগ কাটবে কিনা– এ নিয়ে সন্দিহান।

কিছুদিন আগে সীমান্ত লাগোয়া রেমাক্রি ইউনিয়নের ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেনহাত ম্রো পাড়া, বুলু পাড়া, ইয়ংদং পাড়া, পাইংক্ষ্যং পাড়াসহ আশপাশের ২১টি পাড়ায় খাদ্যসংকটের তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। এর সত্যতা নিশ্চিতে গত ৭ সেপ্টেম্বর এসব পাড়ার উদ্দেশে রওনা দেয় স্থানীয় সাংবাদিকদের একটি দল। এ দলে ছিলেন এ প্রতিবেদক। তাদের সঙ্গে থানচি সদর থেকে যুক্ত হন বিজিবির ২০ সদস্যের দল। থানচি বাজার থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মেনহাত ম্রো পাড়ায় পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় দেড় দিন। প্রতি নৌকায় চালক ও সহকারী ছাড়া যাত্রী ধরে ৬-৭ জন। এর বেশি যাত্রী নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। থানচি বাজার থেকে মেনহাত ম্রো পাড়ায় পৌঁছতে নৌকার ভাড়া গুনতে হয় ২০ হাজার টাকা।

৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে সাংবাদিকরা পৌঁছেন মেনহাত পাড়ায়। তাদের সহায়তায় আসেন ৫৭ বিজিবি বুলুপাড়া ক্যাম্প কমান্ডার ক্যাপ্টেন মো. ইব্রাহিম। ওই পাড়ায় বাস করেন ১৮ পরিবারের সদস্য। সবাই ম্রো। বাঁশের খুঁটি, বেড়া ও পাতা দিয়ে তৈরি বেশির ভাগ ঘরই জরাজীর্ণ। রেংওয়ে ম্রো (২৯) এমনই একটি ঘরে থাকেন পরিবারের চার সদস্য নিয়ে। তাদের এক বেলা খাবারের জন্য রান্না করতে হয় দেড় কেজি চাল। মাসখানেক আগেও বাড়িতে ১০ কেজির বেশি চাল ছিল। জুমের নতুন ধান ওঠার এখনও সপ্তাহ দুয়েক বাকি। সামান্য চাল যা বাকি আছে, তা দিয়েই এই ক’দিন চলতে হবে বলে জানান। আর তাড়াতাড়ি শেষ হলে খাদ্য সংকটে পড়তে হবে। তাই তিন বেলা না খেয়ে এক বেলা খাচ্ছেন তারা। আধা কেজি চালের সঙ্গে বেশি পরিমাণ বাঁশকোড়ল মিশিয়ে রান্না করতে হচ্ছে।

রেংওয়ে ম্রো বলেন, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যের মাধ্যমে দুই দফায় ১০ কেজি করে চাল পেয়েছিলেন। ১০-১২ দিন আগে ম্রো স্টুডেন্ট কাউন্সিলের মাধ্যমে ২৫ কেজি চাল পান। ওই সহায়তায় তাদের চার সদস্যের প্রাণ বাঁচে। এই চালে বড়জোর ১০ দিন যাবে। এর পর হয়তো কারও কাছ থেকে ধার করতে হবে, নয়তো জুমের আধা-পাকা ধান কাটতে হবে।

বুলুপাড়ার দোনক ম্রো (৩২) পরিবারে সদস্য ছয়জন। এক বেলা খেতে লাগে প্রায় দুই কেজি চাল। তাঁর পরিবারকেও ভুগতে হয়েছে খাদ্য সংকটে। তিন দফায় সহায়তা হিসেবে পাওয়া ৪৫ কেজি চালও প্রায় শেষের পথে। দোনক ম্রো বলেন, জুমের ধান পুরোপুরি পাকেনি। আরও ১২-১৫ দিন লাগতে পারে। এ সময় পর্যন্ত কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে অপেক্ষায় থাকতে হবে।

রেমাক্রি ইউনিয়নের ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ২১টি পাড়ায় আছে মোট ৩০২ পরিবার। তাদের অর্ধেকেরও বেশি পরিবার খাদ্য সংকটে পড়েছে। ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন সহায়তা দিয়েছে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মেনহাত ম্রো পাড়া, বুলু পাড়া, ইয়ংদং পাড়া ও পাইংক্ষ্যং পাড়ায়। ছাত্রদের পক্ষ থেকে প্রতি পরিবারকে ২৫ কেজি করে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে ১১টি পাড়ার ১২০ পরিবারকে। এই সহায়তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তারা বলছেন, সব পরিবারে জুমের ধান তুলতে ২০ থেকে ৩০ দিন সময় লাগতে পারে। এই পর্যন্ত সহায়তা প্রয়োজন।

খাদ্য সংকটের কারণ জানতে দুর্গম পাড়াগুলোর জনপ্রতিনিধি, পাড়া কারবারি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয় সমকালের। তারা বলেন, গত বছর প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় অনেক জায়গায় পাহাড় ধসে পড়ে। এতে জুমের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। দুর্গম এলাকার মানুষ এই জুমের ফসলের ওপরই নির্ভরশীল। ফসল নষ্ট হওয়ায় এ বছর জুমের নতুন ধান আসেনি। তাই খাদ্য সংকট দেখা দেয়। থানচি বা রেমাক্রি বাজার থেকে এক বস্তা চাল নিতেও খরচ পড়ে বেশি। থানচি বাজার থেকে মেনহাত পাড়া পর্যন্ত এক বস্তা চাল নিতে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা লাগে। আর রেমাক্রি ইউনিয়ন বাজার থেকে লাগে প্রায় ৪ হাজার টাকা। এসব মানুষের পক্ষে যা অসম্ভব।

রেমাক্রি ইউপির ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মাংসং ম্রো বলেন, প্রশাসন সহায়তার জন্য ২ টন চালের টাকা দিয়েছিল। এ দিয়ে মেনহাত পাড়া, বুলু পাড়া, ইয়ংদং পাড়া ও পাইংক্ষ্যং পাড়ার ৬৫ পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। প্রতি পরিবারে ২০ কেজি করে চাল, তেল, ডাল, লবণ দিয়েছেন। এ দিয়ে তাদের ৭-৮ দিন চলবে। এর পর শেষ হয়ে যাবে। ম্রো ছাত্রদের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলেও শুনেছেন।

৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বিদ্রজয় ত্রিপুরা বলেন, ম্রো ছাত্রদের পক্ষ থেকে পাড়ার লোকজনকে ২৫ কেজি চালসহ ডাল, তেল, নাপ্পি দেওয়া হয়েছে। অন্য কোনো সহায়তা পাননি। মেনহাত ম্রো পাড়ার মতো এ ওয়ার্ডের বেশ কয়েকটি পাড়ার খাদ্য সংকটের তথ্য নিশ্চিত করেন তিনি। এ জন্য জুমের ফসলহানিকেই তিনি দায়ী করেন।

থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মামুন বলেন, ‘শুনেছি গত বছর প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। তাতে ছোট-বড় পাহাড় ধস হয়েছে। জুমের ফসল নষ্ট হয়েছে। এই সময়ে এসে তাদের মধ্যে খাদ্যের কিছুটা অভাব দেখা দিয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিষয়টি জেনেছেন। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে ৬৪ পরিবারকে দুই টন চাল দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ছাত্ররাও চাল দিয়েছেন। এখন খাদ্য সংকট থাকার কথা নয়। কয়েকদিন পরে জুমের পাকা ধান উঠলে সংকট কেটে যাবে।

আরও পড়ুন

×