ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

‘নারী কোনো বিমূর্ত অবয়ব নয়’

‘নারী কোনো বিমূর্ত অবয়ব নয়’

নাজিয়া আন্দালিব প্রিমা

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৪ | ২৩:১৪

উইমেন ইন লিডারশিপ-উইল নারীর অধিকার ও দৃশ্যমানতার একটি উদ্যোগ। দৃশ্যশিল্পী নাজিয়া আন্দালিব প্রিমার শিল্পদর্শনের প্রকৃত বাস্তবায়ন উইল নারীকে তার স্বীয় মর্যাদায় প্রতিস্থাপনের  বাস্তব রূপ। নারীর অন্তর্ভুক্তিকরণ, বহুমুখিতা, স্থায়িত্ব, প্রেরণা, অবদান, অধ্যবসায়, পেশাদারিত্বসহ তার অকল্পনীয় ক্ষমতা, সৃজনশীলতা এবং অবারিত সম্ভাবনার দৃশ্যমান রূপ ঘটে উইলের মাধ্যমে। উইলের দীর্ঘ ১০ বছরের পথচলায় নাজিয়া আন্দালিব প্রিমার অভিব্যক্তি জানবার আগ্রহে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। 

নাজিয়া আন্দালিব প্রিমা বাংলাদেশের একজন সফল, সাহসী এবং বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সমসাময়িক শিল্পীদের প্রতিনিধি; যিনি একজন শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ইনফ্লুয়েন্সার, নেতা এবং কর্মী। তিনি নতুন মিডিয়ার (শিল্প, নেতৃত্ব, কর্মক্ষমতা) গতিশীল ধারণা, কৌশল নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। 
তিনি প্রিমা আর্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ার, উইমেন ইন লিডারশিপের সভাপতি, বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের পরিচালক ও সৃজনশীল সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্রিয়েটিভ ফোরাম ও প্রিমাস অ্যাটেলিয়ারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ২০২৩-২৪ সালের জন্য সুপারব্র্যান্ডস বাংলাদেশের কাউন্সিল বোর্ডের একজন বিশিষ্ট সদস্য। 

•দশ বছর আগে বাংলাদেশে উইমেন ইন লিডারশিপ প্রতিষ্ঠা করার নেপথ্যে কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক চাহিদা ও সমস্যা কি আপনাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল?

••২৫ বছর ধরে আমি দৃশ্যশিল্প ও কৃৎকলা চর্চা করে আসছি।  শিল্পের এই সুদীর্ঘ পথপরিক্রমা থেকে আমার লব্ধ জ্ঞান ও দর্শন আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে নারীর নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়নের বাস্তব রূপকল্প সৃষ্টিতে। ‘উইল’-এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘নারীর অধিকার এবং দৃশ্যমানতাবোধ’ এই দর্শনের ওপর ভিত্তি করে পেশাজীবী নারীদের সম্ভাবনার ওপর আলোকপাত করা এবং তার ফলপ্রসূ একটি পদ্ধতি নির্ধারণ করা। ২০১৪ সালে উইল যাত্রা শুরু করে। লিঙ্গ বৈচিত্র্য সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে এবং নেতৃত্বের জন্য নারীদের উৎসাহিত করা উইলের সর্বোপরি প্রয়াস। গত ১০ বছরের প্রচেষ্টায় উইল নারী ক্ষমতায়নের একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।

•সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই উদ্যোগ কীভাবে আরও বিকশিত হয়েছে?

••১০ বছর ধরে এই উদ্যোগ নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের বিবিধ ধারা নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সম্ভাবনাময় নারীদের মেন্টরিংয়ের মাধ্যমে পেশাগত জীবনের বিভিন্ন ধাপ শনাক্ত এবং উপবিষ্ট করা। ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য তাদের প্রস্তুতে উইল বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করে। বার্ষিক উইল ফেস্ট, প্রকাশনা, সম্মাননা এবং আরও কিছু কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উইলের মূল উদ্দেশ্য সবসময় সচল রাখে। উইল নিজের কথাগুলো প্রতিনিয়ত মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে এবং এই এক দশকে উইল সমাজের একটি আলোচ্য বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।  

•এ বছরের উইল ফেস্টের মূল প্রতিপাদ্য কী? 

••দশ বছরে উইলের অবদান সমাজের পেশাজীবী নারীকে আরও বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করেছে। উইল যেহেতু একটি দর্শনভিত্তিক উদ্যোগ, সেহেতু এবারের মূল প্রতিপাদ্য– ‘নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা’। প্রশ্ন উঠতে পারে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কি বিশ্বজুড়ে জটিল লিঙ্গসমতা এবং বৈচিত্র্য বিতর্কের সমাধান করতে পারে? যদিও উত্তরটি সুচারুরূপে দেওয়া সম্ভব না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীকে ক্ষমতায়নের জন্য একটি শক্তিশালী পটভূমি দেয়।
২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনে নারীর অবদান অপরিমেয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫৩ বছরে উপনীত এবং এই উদযাপনের নতুন অধ্যায় রচিত হবে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও মুক্তির আলোকে।  
এই বছর উইল ফেস্ট (সভা, সম্মাননা, শিল্প ও প্রকাশনা) প্ল্যাটফর্মটি কীভাবে নারীদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করতে পারে তার ওপর আলোকপাত করবে। এ বছরের অন্যতম সংযোজন ‘উইল আর্ট’। মূলত রূপক ও চিত্রমাধ্যমের সহায়তায় উইল আর্ট প্ল্যাটফর্ম নারীদের অধিক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ভূমিকা পালন করতে অনুপ্রাণিত করবে। দৃশ্যমানতার সঙ্গে শিল্পদর্শনের সংযোগ সূত্র রচনা করবে উইল আর্ট।

•এ বছরের উইল শীর্ষ সম্মেলনের আলোচনায় কোন বিষয়গুলো অধিক গুরুত্ব পাবে? 

••২০২৪ সালে আমরা উপনীত। সময়ের সঙ্গে নারীর অগ্রযাত্রাও অপরিমেয়। নারী আজ সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান এবং বিস্তৃত। এ বছর উইল সামিটের আলোচনায় প্রযুক্তি উদ্ভাবন, সৃজন, ব্যবসা এবং বহুমুখী বিচিত্র বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সমাজের নানা স্তরের বিবিধ পেশার ব্যক্তিরা তাদের অভিজ্ঞতা, পর্যালোচনা এবং প্রক্রিয়া তুলে ধরে একটি সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেবেন। ৯ মার্চ দিনব্যাপী এ সামিট অনুষ্ঠিত হবে। 

•ইন্সপায়ারিং উইমেন অ্যাওয়ার্ড সম্মাননাটি কীভাবে উইলের মূল ভিত্তিকে সহায়তা করে? 

••আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, যে কোনো পেশার নারীর জন্যই তাঁর কাজের স্বীকৃতি পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই স্বীকৃতির মাধ্যমে তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। ইন্সপায়ারিং উইমেন অ্যাওয়ার্ড সম্মাননাটি একটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ মনোনয়ন এবং নির্বাচন পদ্ধতি রয়েছে। এটি একটি নিরপেক্ষ, উন্মুক্ত এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়াও। এ সম্মাননা শুধু যোগ্যদেরই পুরস্কৃত করে না, বরং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রবৃদ্ধি এবং সহায়ক প্যারামিটারও তৈরি করে।
আমার মতে, নারী পেশাজীবীদের দক্ষতা ও ক্ষমতা সম্পর্কে আরও আত্মবিশ্বাসী এবং সচেতন করে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে একই দক্ষতার অধিকারী নারী পেশাজীবীরা প্রায়ই তাদের পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় কম আত্মবিশ্বাসী। তার পেছনে কারণ প্রথমত সে নিজে, দ্বিতীয়ত প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত ত্রুটি।  
আমি মনে করি, এই সম্মাননাটি শুধু বিজয়ীদের আত্মবিশ্বাসই বাড়ায় না, বরং তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছাপ রেখে যেতেও অনুপ্রাণিত করে।

•উইল আপনারই জীবনদর্শন। এই দর্শনের আলোকে আগামীর নারীর উপস্থাপন কী হতে পারে?  

••আমার স্বাধীনতা আমার শক্তি, অস্ত্র। আমার নারীসত্তা কেবল স্বীয় অস্তিত্বই ধারণ করে না; এটি আমার পরিবেশ, জীবন এবং তারও অধিক রূপে আমাকে প্রকাশিত এবং উন্মুক্ত করে।  
আমি নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার পুরোপুরি সমর্থনে বলব, স্বাবলম্বী নারী স্বাধীন নারী। নারীকেই উপলব্ধি করতে হবে তার অধিকার। নারী যেদিন মা, বোন, কন্যা, জায়া উপাধি থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে শিখবে; সেদিনই সে তার মানসিক, শারীরিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার কড়ায় গণ্ডায় দাবি করবে।    

•বাংলাদেশের পেশাজীবী নারীদের কী বার্তা দিতে চান?

••পেশাজীবী নারী বলে আমি নারীকে আবারও কোনো শিকলে বাঁধতে চাই না। হাজার বছরের ইতিহাসে নারীকে অভিহিত করার যে ছল রচিত হয়েছে সমাজে; তারই বিপরীতে দাঁড়িয়ে উইল। নারীর সমন্বিত শক্তি, তাদের একত্রিত ক্ষমতা এবং তার এ বাস্তবায়নের প্রয়াস। নারী কোনো বিমূর্ত অবয়ব নয়, বরং সে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক শক্তির আধার– যা আজও পৃথিবীর কাছে অজানা তার উন্নাসিক অবহেলায়।  
নারীকে হতে হবে সজাগ, সচেতন, উদ্যোগী তার নিজের অধিকারে, চেতনায় এবং বোধে। তখনই সে বিষয় হবে না আলোচনার, উদ্যোগের বা কোনো প্রকার স্বীকৃতির। সে তার নিজ ক্ষমতাবলে অবস্থান করবে এই ধরাতলে। 

আরও পড়ুন

×