রাজপথ দখলের লড়াই সংকট আরও বাড়াবে

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২২ | ১৪:৩৬
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- দু'দলই রাজপথ দখলের হুমকি দিচ্ছে। রাজপথে 'মোকাবিলা ও ফয়সালার' কথা বলছেন দু'দলের নেতারা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডলার ও জ্বালানি সংকট এবং বৈশ্বিক অস্থিরতায় অর্থনীতি টালমাটাল। সাধারণ মানুষ পড়েছে জীবন-জীবিকার চাপে। এমন বিপৎসংকুল সময়ে রাজনৈতিক সংঘাতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। তাই সাধারণ মানুষকে রক্ষায় বিশিষ্টজনের তরফ থেকে রাজনৈতিক উদারতা ও ঐকমত্যের তাগিদ এসেছে।
বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ করছে বিএনপি। ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের সমাবেশ বাধামুক্ত হলেও পরের ময়মনসিংহ ও খুলনার কর্মসূচিতে পদে পদে বিপত্তি ছিল। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি ছিল বর্ণনাতীত। শ্রমজীবী মানুষের জীবিকা বিঘ্নিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, বিএনপিকে রাজপথ ইজারা দেওয়া হয়নি, আওয়ামী লীগও রাস্তায় নামবে। আওয়ামী লীগের এমন বক্তব্যে অনেকটা স্পষ্ট, বিএনপির বাকি সাত বিভাগীয় সমাবেশ ও অন্য কর্মসূচি 'সহজ' হবে না।
রাজনৈতিক উত্তেজনা সংঘাতে রূপ নিলে অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়বে বলে সতর্ক করেছেন গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি সমকালকে বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটে বিনিয়োগ কম হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিনিয়োগের চেয়ে ভোগের অবদান থাকবে বেশি। একে সুরক্ষা দিতে স্থিতিশীলতা এবং নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক অস্থিরতায় স্থিতিশীলতা ও সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত করলে অর্থনীতিতে বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাজনৈতিক ডামাডোল শুধু বাজার ব্যবস্থাকে অনিশ্চিত নয়, আমন সংগ্রহ প্রক্রিয়া এবং এক কোটি পরিবারকে খাদ্য সহায়তার কর্মসূচিও বাধাগ্রস্ত করবে। নিম্নবিত্ত এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, যাঁরা জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ। পরিবহন, দোকানপাট ও কারখানা বন্ধ হলে বেশিরভাগ মানুষ বিপদে পড়বে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, খুচরা ব্যবসায়ী, কর্মপ্রত্যাশী- সবাই এতে প্রভাবিত হবেন।
পরিস্থিতি যে খারাপের দিকে যাচ্ছে, তা প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বক্তব্যেই স্পষ্ট। গতকাল রোববার তিনি বলেছেন, 'রিজার্ভের যে অবস্থা, জানি না সামনে কী হবে! এলএনজি এখন আমরা আনছি না। এ সময়ে ২৫ ডলার হিসাব ধরেও যদি এলএনজি আমদানি করতে যাই, তাহলে ছয় মাসের চাহিদা মেটানোর মতো অবস্থা (টাকা) আছে কিনা, জানি না। সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করেই দিতে হবে।'
বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি ইতিহাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ম্ফীতি ১১ বছরে সর্বোচ্চ। ঢাকা নগরেই আট ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। কলকারখানার উৎপাদন কমেছে। রপ্তানি নিম্নমুখী। রেমিট্যান্স কমছে। নিত্যপণ্যের দামে মানুষ দিশেহারা। ঋণের জন্য আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কাছে যেতে হয়েছে। রাজনৈতিক সংঘাতে স্বাভাবিক কর্মপরিবেশ ও যোগাযোগ ব্যাহত হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। অর্থনীতিকে সুরক্ষা দিতে সব পক্ষের ঐকমত্যের কথা বলেছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেছেন, এ উদ্যোগ আসতে হবে যাঁরা দেশ পরিচালনা করছেন, তাঁদের কাছ থেকে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে থাকতে হবে।
তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের কাছ থেকে ঐকমত্যের আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার পতনে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। বিরোধী দল বাধামুক্ত কর্মসূচি পালন করতে পারবে, তেমন আশাও দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল হুঁশিয়ার করে বলেছেন, 'খেলা হবে ডিসেম্বরে।'
'রাজনৈতিক সংঘাতে কেউ নিহত হলে দায় সরকারকে নিতে হবে'- বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এ বক্তব্যের জবাবে আগের দিন তিনি বলেছেন, 'এখন তারা (বিএনপি) যদি উস্কানি দিয়ে লাশ ফেলতে চায়, এখানে সরকার দায় নেবে না।'
বিএনপির কর্মসূচিতে বিপুল গণজমায়েতের পাল্টা হিসেবে আওয়ামী লীগও বড় শোডাউন দেখাতে চায়। ২৯ অক্টোবর ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে, ১১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুবলীগের ব্যাপক জনসমাগম ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। যুব মহাসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থাকবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন সংগঠনের নেতারা। এ ছাড়া বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকে রাজপথে নেমে মাঠ নিজেদের দখলে রাখার হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে বিএনপির পাল্টা বলছেন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ। তিনি বলেছেন, বিএনপির কর্মসূচি নিয়ে মাথাব্যথাও নেই। আওয়ামী লীগ দলের জেলা-উপজেলাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সম্মেলনসহ সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত। ডিসেম্বরে জাতীয় কাউন্সিল। এর পর শুরু হবে নির্বাচনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি।
বিএনপি নেতারা বলছেন, তাঁরা অশান্তি চান না; বরং তাঁদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও প্রশাসন বাধা দিয়ে, বিএনপি নেতাকর্মীদের হত্যা ও বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর করে সংঘাত বাধানো হচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে না পেরে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সংঘাত সৃষ্টি করছে পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে নিতে। এভাবে চলতে থাকলে একটা সময়ে তা সংঘাত-সংঘর্ষে রূপ নিতে বাধ্য হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, গা বাঁচাতে সরকার রাজনীতি বাদ দিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণা করলেই সরকারের মাথা খারাপ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগই ত্রাস ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে।
তবে রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টিকে খারাপ মনে করছেন না বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, সমাবেশ হলেই যে সংঘাত, এমন নয়। যদি কোনো জায়গায় বলপ্রয়োগ হয়, তাহলেই সংঘাত হতে পারে। পাল্টাপাল্টি সমাবেশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হলে জনগণের যাচাই-বাছাইয়ে সুবিধা হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য সরকার ও সরকারি দল দায়ী বলে মনে করেন। তিনি বলেন, বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা সরকারের দুর্বলতার পরিচয়। বিএনপি শাসনামলেও এটার আরেকটি সংস্করণ ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, দুই রাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতার লড়াইয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। কষ্টে থাকা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকট ও যুদ্ধে মন্দা, খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। রয়েছে বিদ্যুৎ সংকট, ডলার সংকট, কর্মসংস্থানের সংকট। সব সংকট যখন সাধারণ মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, তখন দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতার কাড়াকাড়িতে ব্যস্ত। আর তাতে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন। রাজনৈতিক দলের বাইরে থাকা নাগরিক সমাজকে ভূমিকা নিতে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থা কী হবে, কেমন হবে- এ প্রশ্নের সুরাহা স্বাধীনতার ৫০ বছরেও করতে পারলাম না। আর এ নিয়ে প্রতিবারই সংঘাত, হাঙ্গামা, প্রাণহানি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কিছুতেই দেখতে চাই না।
গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানে গুরুত্ব দিচ্ছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। সমকালকে তিনি বলেন, রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করুক, তবে সচল থাকুক শিল্পোৎপাদন। মনে রাখতে হবে, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল থাকলে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে, দেশ বাঁচবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক উত্তাপ থাকবেই। কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট রাজনৈতিক কারণে নয়। এ সংকট শুধু বাংলাদেশে নয়, বৈশ্বিক।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে যা হচ্ছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগের। দলটির আরও সমাবেশ হবে এবং আওয়ামী লীগও একইভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করবে। এটা কারও জন্য মঙ্গলজনক নয়। এর যৌক্তিক সমাধান সম্ভব। তাঁর মতে, যেদিন এক বিভাগীয় শহরে বিএনপি সমাবেশ করবে, সেদিন আওয়ামী লীগ অন্য বিভাগীয় শহরে কর্মসূচি করে জনসমর্থন তুলে ধরতে পারে। তাহলে সংঘর্ষ, যানবাহন বন্ধের ভোগান্তি থেকে জনগণ রেহাই পেতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, রাজনীতিবিদরা যৌক্তিক সমাধানের পথে হাঁটেন না। তাই আশাঙ্কা থাকছে, সংঘাত বাড়বে।