ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

পাপুল দম্পতিসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করছে দুদক

পাপুল দম্পতিসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করছে দুদক

ছবি: ফাইল

হকিকত জাহান হকি

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২০ | ১৪:৫৬

অর্থ পাচারের অভিযোগে কুয়েতে বন্দি লক্ষ্মীপুরের এমপি মোহাম্মদ শহীদ ইসলাম পাপুল, তার স্ত্রী, শ্যালিকা, মেয়েসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে ১৪৮ কোটি ২১ লাখ টাকা পাচারের প্রমাণ মিলেছে। এ নিয়ে আজকালের মধ্যে মামলা করা হবে। এ ছাড়া পাপুলসহ সাত-আটজনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দুদক সূত্রে এ খবর জানা গেছে।

দুদকের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, এনআরবি কমার্শিয়ালসহ তিনটি ব্যাংকে পাপুলের শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের নামের পাঁচটি হিসাবে জমা হয় মোট ১৪৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও অনেকের ব্যাংক হিসাব থেকে পাঁচটি হিসাবে ওই পরিমাণ টাকা জমা করা হয়। পরে তা থেকে এরই মধ্যে ১৪৮ কোটি ২১ লাখ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়।

দুদক সূত্র জানায়, পাপুল, তার স্ত্রী ও তাদের মেয়ের ব্যাংক হিসাব থেকেও জেসমিন প্রধানের হিসাবগুলোতে টাকা জমা হয়েছে। পাপুলের অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ নিজের, স্ত্রী ও মেয়ের হিসাবে জমা রাখা হয়েছিল। পরে ওই অর্থ শ্যালিকার হিসাবগুলোতে স্থানান্তর করা হয়। এরপর শ্যালিকার হিসাব থেকে তা উত্তোলন করে বিদেশে হুন্ডি বা অন্য কোনো মাধ্যমে পাচার করা হয়। বিদেশে অর্থ পাচারে পাপুল কয়েকটি ধাপে স্ত্রী, মেয়ে ও শ্যালিকার ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেছেন।

এনআরবি কমার্শিয়াল, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ও সিটি ব্যাংকে জেসমিন প্রধানের পাঁচটি হিসাব থেকে ওই পরিমাণ টাকা পাচার বা আত্মসাতের পর এখন স্থিতির পরিমাণ যৎসামান্য।

দুদকের মামলায় আসামি করা হচ্ছে পাপুল, তার স্ত্রী সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি কাজী সেলিনা ইসলাম, মেয়ে ওয়াফা ইসলাম ও শ্যালিকা জেসমিন প্রধানকে। তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ অনুসন্ধান করেছেন দুদকের ঢাকার প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন। পুরো অনুসন্ধান কার্যক্রম তদারক করেছেন দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন। এরই মধ্যে কমিশন মামলাটির অনুমোদন দিয়েছে। উপপরিচালক সালাহউদ্দিন অভিযুক্তদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগটিও অনুসন্ধান করছেন।

দুদকের অনুসন্ধানে জেসমিন প্রধানের নামে দুই কোটি ৩১ লাখ টাকার একটি এফডিআরের সন্ধান পাওয়া গেছে। জানা গেছে, জেসমিন তথ্য গোপন করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। তাই তার বিরুদ্ধে দুদক আইন-২০০৪-এর ২৭(১) ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

জানা গেছে, পাপুল, তার স্ত্রী ও মেয়ে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে এফডিআর হিসেবে জমা করেন। ওইসব এফডিআরের বিপরীতে জেসমিন প্রধান ২৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকার ঋণ সুবিধা গ্রহণ করেন। বিভিন্ন ব্যাংকে জেসমিন প্রধানের নিজ নামে ও তার স্বার্থসংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে করা ব্যাংক হিসাবে ২০১২ সালের জুন থেকে চলতি বছরের ৭ জুন পর্যন্ত মোট ১৪৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা জমা হয়। পরে এসব হিসাব থেকে ১৪৮ কোটি ২১ লাখ টাকা পাচার বা আত্মসাৎ করা হয়।

অবৈধ সম্পদের অভিযোগ : মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলাটি করার পর পাপুল দম্পতি ও তাদের মেয়ে ছাড়াও তাদের সহযোগী কাজী মো. জামশেদ কবির (বাকী বিল্লাহ), ইসমাইল হোসেন খোকন, আলতাফ হোসেন হাওলাদারসহ অন্য অভিযুক্তদের কাছে সম্পদের হিসাব চাওয়া হবে। পরে তাদের সম্পদ যাচাই করা হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া গেলে বা অর্থ পাচার-সংক্রান্ত কোনো অপরাধ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পাপুল : দুদকের অনুসন্ধানে এরই মধ্যে পাপুলের নামে-বেনামে শুধু দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৯০ কোটি টাকার স্থাবর ও প্রায় ৬১ কোটি টাকার অস্থাবরসহ প্রায় ১৫১ কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান মিলেছে। এ সম্পদের বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। তিনি মানব পাচারসহ নানা দুর্নীতির মাধ্যমে এ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে তথ্য পেয়েছে দুদক। ধারণা করা হচ্ছে, তার নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে আরও শত শত কোটি টাকার সম্পদ থাকতে পারে।

সেলিনা ইসলাম : তার নামে দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৯০ কোটি টাকা স্থাবর ও প্রায় ৬৯ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদসহ প্রায় ১৫৯ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে তার আরও শত শত কোটি টাকার সম্পদ থাকতে পারে।

ওয়াফা ইসলাম : তিনি একজন শিক্ষার্থী। তার ব্যক্তিগত কোনো আয় নেই। এর পরও তার নামে ২৪ কোটি ২৯ লাখ ৪৫ হাজার ৭২৫ টাকার অস্থাবর সম্পদ পাওয়া গেছে।

জেসমিন প্রধান : তার নামে ৩৪টি এফডিআরে অর্থ নগদ জমা রয়েছে। এফডিআরের মোট টাকা দুই কোটি ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৭ টাকা। তিনি এই অর্থের বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি এবং তিনি তা আয়কর নথিতে প্রদর্শন করেননি।

জামশেদ কবির : তার নামে উত্তরা ১১নং সেক্টরের ৬নং রোডে ৩০নং বাড়িতে চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার মূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে তার নামে ছয়তলা বাড়ি রয়েছে, যার মূল্য প্রায় আট কোটি টাকা। অনুসন্ধানে তার নামে ১০ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া রাজধানীর উত্তরার আশকোনায় তার নামে ১১ শতক জমি রয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা। তার নামে একাধিক গাড়ি রয়েছে। কানাডা ও কাতারে তার নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ রয়েছে। জামশেদ কবির পাপুলের সঙ্গে মানব পাচারসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসায় জড়িত ছিলেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।

ইসমাইল হোসেন খোকন : তার নামে আনুমানিক পাঁচ কোটি আট লাখ টাকার স্থাবর এবং এক কোটি ৫১ লাখ টাকার অস্থাবরসহ প্রায় ছয় কোটি ৫৯ লাখ টাকার সম্পদের তথ্যাদি পাওয়া গেছে। দেশের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। পাপুলের সঙ্গে মানব পাচারসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসায় জড়িত। পাপুলের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় প্রায় ১০ কোটি টাকা নিয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে দুদকের কাছে।

এ ছাড়া আলতাফের নামে দুই কোটি টাকার স্থাবর ও ৫০ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্য রয়েছে দুদকের হাতে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তার নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের তথ্য মিলেছে। পাপুলের সঙ্গে মানব পাচারসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আলতাফ একটি অবৈধ ঘাট থেকে বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জন করেন। তা ছাড়া সরকারের প্রায় সাত হাজার একর জমি প্রভাব খাটিয়ে চাষাবাদ করে সেখান থেকে বছরে প্রায় ২০ কোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জন করেন।

মানব ও অর্থ পাচারের অভিযোগে চলতি বছরের গত জুনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি পাপুলকে গ্রেপ্তার করেছে কুয়েতের সিআইডি। তিনি বর্তমানে দেশটির কারাগারে আছেন। গোয়েন্দাদের রিমান্ডে পাপুলের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কুয়েতের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে পাপুলের নামে জমা থাকা ১৩৮ কোটি টাকা জব্দ করা হয়েছে।

তার বিরুদ্ধে দুদকে পেশ করা অভিযোগে বলা হয়, তিনি কুয়েতে মানব পাচার করে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জন করেছেন। হুন্ডির মাধ্যমে ওই অর্থ দেশে আনা ও বিভিন্ন দেশে পাচারের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগে। হুন্ডি ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে ২০১৬ সালে বিদেশ থেকে ২৮০ কোটি টাকা দেশে এনেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

আরও পড়ুন

×