ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

গল্প

হাহা ভূত আর হিহি ভূত

হাহা ভূত আর হিহি ভূত

ছবি এঁকেছেন তন্ময় শেখ

নুরুল ইসলাম বাবুল

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৪ | ০১:২৪

গ্রামের নাম কাজল। চোখের কাজলের মতো সুন্দর! গ্রামটা শহর থেকে অনেক দূরে। নানান গাছগাছালিতে ভরা। দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। আশপাশে চোখে পড়ে না লোকালয়। সরু একটা মেঠো পথ গ্রামের ভেতর দিয়ে ছোট্ট মেয়ের চুলের ফিতের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে তেপান্তরের মাঠের দিকে। রাস্তাটা যেখানে থেমেছে, ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে একটা বটগাছ। বেশ বড়োসড়ো আর অনেক বয়সী। দিনে বটের ছায়ায় বসে রাখালদের আড্ডা। গরু চরাতে গিয়ে তারা এই বটগাছের ঘন ছায়ায় বসে বসে গল্প করে। অলস সময় কাটায়। গান গায় গলা খোলে। বাঁশি বাজায় মনের সুখে। কেউ কেউ আরাম করে ঘুমিয়েও নেয়। তবে সন্ধ্যা হতেই পাল্টে যায় দৃশ্য! কেউ এই পথটা মাড়াতে চায় না। যেতে চায় না বট গাছের নিচে। দিনের আলো নিভতেই এখানে যে ভূতের আনাগোনা! 
গ্রামের সবার জানা, দুইটা ভূত বাস করে এই বুড়ো বটগাছটায়। থাকে একেবারে মগডালে। একটা হাহা ভূত। সে হাহা করে হাসে। আরেকটা হিহি ভূত। সে হিহি করে হাসে। তাদের অনেক ছেলেমেয়ে ছিল। তারাও হাহা আর হিহি করে হাসতো। একদিন রাগের মাথায় ছেলেমেয়েদের তাড়িয়ে দিয়েছে হাহা ভূত। ছেলেমেয়েরা গাছ থেকে গিয়ে আস্তানা গেড়েছে ইটাখোলার ভিটায়। হাহা ভূত তাদের দেখতে যায় না। হিহি ভূত মাঝে মাঝে যায়। চলে যাওয়ার পর ওরা একবারও এখানে আসেনি। তাদেরও যে বড্ড অভিমান!
হাহা ভূত আরাম করে ঘুমায়। গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালের দুই পাশে পা ঝুলিয়ে। হিহি ভূত টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। সাঁঝবেলায় ফিরে। তখন দুইজন বসে গল্প করে। আজও গল্প করছিলো। হঠাৎ একঝাঁক পাখি খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠলো। হাহা ভূত পাখিদের বিপদ টের পেলো। হাহা ভূত আর হিহি ভূত ছাড়াও এই গাছে বাস করে ঝাঁকে-ঝাঁকে পাখি। নানান রকম পাখির কিচিরমিচিরে মুখর হয়ে থাকে বুড়ো বটগাছটি। তারা মাঠ থেকে ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় 
ধরে খায়। মনের আনন্দে গান গায়। পাখিদের গান শুনে-শুনে হাহা ভূত ভালো ঘুমাতে পারে। তাই পাখিরা ওর বন্ধু। ওদের বিপদ হলে এগিয়ে আসে। হিহি ভূতও সাহায্য করে। 
চেঁচামেচি শুনে ঘুরে তাকালো হাহা ভূত। হিহি ভূত বললো, ওই দেখো, দুষ্ট ছেলেরা আবার এসেছে। পাখির বাসা ভাঙতে, ছানাগুলো ধরে নিতে। হাহা ভূত রাগে কাঁপতে লাগলো। তার লালচোখ আরও লাল হয়ে উঠলো। 
হিহি ভূত খোঁটা দিয়ে বললো, এই জন্য নিজের ছেলেমেয়েদের তাড়িয়ে দিয়েছ। এখন মানুষের ছেলেদের কী করবে, শুনি? 
হাহা ভূত এবার রেগে আগুন! দুই হাত লম্বা করে ধাক্কা মেরে দিলো। দুষ্ট ছেলেরা একসাথে সবাই গাছ থেকে পড়ে গেলো। কে কার গায়ের উপর গিয়ে পড়লো, ঠিক নাই। সেই সাথে যার-যার মতো কোনোভাবে উঠেই ভোঁ-দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে কেউ বললো, লম্বা ভূত। কেউ বললো, আগুনচোখা ভূত। কেউ কোনো কথাই বলতে পারলো না। যাই হোক, পাখিরা বেঁচে গেলো। তাদের বাসাও ভাঙা পড়লো না।
একদিন তেপান্তরের মাঠে কিছু লোক এলো। দামি গাড়ি নিয়ে। শহর থেকে এসেছে নাকি তারা। হাহা ভূত আর হিহি ভূত কখনো শহরে যায়নি। এই নিরিবিলি জীবন তাদের পছন্দ। শহরের লোকগুলোকে দেখে হিহি ভূত অনেক সময় ধরে হিহি করে হাসলো। হাহা ভূত ধমক দিয়ে থামিয়ে না-দিলে হয়তো সে হাসতেই থাকতো।
লোকগুলো হেঁটে হেঁটে বটগাছের ছায়ায় এসে দাঁড়ালো। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলো। হিহি ভূত বললো, দেখেছো, ওরা কী সুন্দর করে কথা বলে! 
হাহা ভূত থামিয়ে দিয়ে বললো, কথাগুলো শুনতে দাও।
লোকগুলোর মধ্যে যে সবচেয়ে লম্বা, সে বললো, বটগাছের ওই পাশের জমিটায় আমরা ইটভাটার জন্য কিনতে চাই।
আরেকজন বললো, হ্যাঁ, এটা ভালো হবে। রাস্তাও পাকা হয়ে যাচ্ছে। ইট তৈরির মাটিও এখানে পাওয়া যাবে।
হিহি ভূত কিছু সময় হিহি হেসে বললো, শুনেছো, কাজল গ্রামের রাস্তা পাকা হবে। কিছুদিন আগে বিদ্যুৎ এসেছে। আগে সাঁঝ নামলেই আঁধারে গ্রামটা ডুবে যেতো, এখন কী সুন্দর আলো ঝলমল করে। আবার রাস্তাও পাকা হবে।
হাহা ভূত ধমক দিয়ে বললো, তাতে তোর কী? আর শুনছিস না, লোকগুলো এখানে ইটভাটা বানাবে। হিহি ভূত না-বুঝেই হিহি করে হাসতে লাগলো।
কিছুদিনের মধ্যেই কাজল গ্রামের সরু মেঠো রাস্তাটা পাকা হয়ে গেলো। একবারে বটগাছের নিচে গিয়ে গাড়ি থামে। গ্রামের লোকজন গাড়িতে চড়ে জমি দেখতে যায়। সেইসাথে ইটভাটা তৈরির কাজও শেষ হলো। ইট তৈরি হলো। শুরু হলো ইট পোড়ানোর কাজ। ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় ভারি হয়ে উঠলো বাতাস। কিছুদিনের মধ্যেই বটগাছের পাতাগুলো ঝিমিয়ে পড়লো। রাতের আঁধারে অনেক ডালপালা কাটা হলো। পাখিগুলো একে একে চলে যেতে লাগলো। ছায়াহীন গাছের নিচে কাজল গ্রামের রাখালরাও আসে না। তাদের বাঁশির সুরও বেজে ওঠে না।
হিহি ভূত আর হিহি করে হাসে না। হাহা ভূত একটুও ঘুমাতে পারে না।
হিহি ভূত কাতর কণ্ঠে বললো, এই বিষাক্ত বাতাসে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিছু একটা করো।
হাহা ভূত কোনো কথা বলে না।
তারপর এক রাতে হাহা ভূত আর হিহি ভূত কোথায় চলে গেলো, তা আর জানা গেলো না! n

আরও পড়ুন

×