ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ঘরের সব বাতি নিভিয়ে স্যারের গান শুনব

ঘরের সব বাতি নিভিয়ে স্যারের গান শুনব

অধ্যাপক আনিসুর রহমান (২২ জুলাই ১৯৩৩–৫ জানুয়ারি ২০২৫)

সেলিম জাহান

প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:৫১ | আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৩:৫৭

অ ধ্যাপক আনিসুর রহমানকে আমি প্রথম দেখি ১৯৭২ সালে। তবে তাঁর খ্যাতি আমাদের কাছে পৌঁছেছিল বহু আগেই। খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব হাফিজুর রহমানের পুত্র প্রবাদপ্রতিম ছাত্র এবং শিক্ষক অধ্যাপক আনিসুর রহমানের নাম আমাদের সবার জানা। স্বল্প পাতায় লেখা তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের কথা শুনে আমরা মুগ্ধ হতাম। ষাটের দশকে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সঙ্গে তাঁর সীমান্ত অতিক্রম করার গল্প, মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের জন্য তাঁর কাজ– এসব কিছুই আমাদের জানা ছিল।

১৯৭২ সালে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম যখন দেখা হয়, তিনি তখন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য। শোনা গেল, পরিকল্পনা কমিশনের দু’জন সদস্য বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’একজন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলতে চান। সেই সূত্রেই ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে মধ্যাহ্নভোজের সময়ে আমি তাঁকে এবং অধ্যাপক মোশাররফ হোসেনকে প্রথম দেখি। যতদূর মনে পড়ে, সঙ্গে ছিল আমার সতীর্থ বন্ধু আবদুল্লাহ শিবলী।

প্রথম দর্শনেই আমি মুগ্ধ হলাম। অত্যন্ত সুদর্শন, মিতভাষী জ্ঞানী মানুষকে আমার খুব ভালো লেগে গেল। তার কিছুদিন পরই তাঁকে আমরা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে পেলাম। এমএ ক্লাসে তিনি আমাদের পড়াতেন ‘ক্যাপিটাল থিওরি’। ‘পেঙ্গুইন’ প্রকাশনার ‘ক্যাপিটাল থিওরি’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত গ্রিক অর্থনীতিবিদ পিয়ার অ্যাঞ্জোলো গ্যারেগনেনির একটি প্রবন্ধের ওপর ভিত্তি করে আমাদের পুরো তত্ত্বটি পড়িয়ে দিয়েছিলেন। ৫০ বছর পরও আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। আমার অর্থনীতির সতীর্থদের ক্ষেত্রেও সেটা সত্য হবে। তার চেয়েও বিস্ময়ের ব্যাপার, বহু বছর পরে আজ থেকে বছর ১৫ আগে নিউইয়র্কে একবার আমি যখন এ কথা মনে করিয়ে দিলাম, তিনি এর কিছুই মনে করতে পারলেন না। না প্রবন্ধটির কথা, না এর ওপরে ভিত্তি করে তাঁর পড়ানোর ব্যাপারটি। 

আমরা যখন এমএ ক্লাসের ছাত্র, তিনি তখন বিভাগীয় প্রধান এবং আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি সমিতির সহসভাপতি। সুতরাং ক্লাসের বাইরেও তাঁর সঙ্গে নানান কাজ করতে হতো। পরবর্তী সময়ে সত্তরের দশকে আমি তাঁর সহকর্মী হলাম। তিনি যখন বিভাগীয় প্রধান এবং আমি একজন তরুণ প্রভাষক, তখন আমাকে সভাপতি করে অর্থনীতির পাঠ্যসূচি সংস্কারে তিনি একটি পর্ষদ গঠন করে দিয়েছিলেন। বহু খেটে আমি একটি সংস্কার প্রস্তাবমালা তৈরি করে দিয়েছিলাম। কিছু কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনলেও প্রয়োজনীয় খোলনলচে বদলানো হয়নি। বহু পরে আমাদের গল্পকালে স্যার সে ব্যাপারে তাঁর মনোভঙ্গের কথা বলেছিলেন।

দুই দশক আগে আমি যখন জাতিসংঘে কর্মরত, অধ্যাপক আনিসুর রহমান নিউইয়র্কে এলেই আমাদের দেখা হতো। তিনি আসার আগেই জানান দিতেন বার্তার মাধ্যমে। কখনও ক্যালিফোর্নিয়ায় তাঁর মেয়ের ওখানে যাওয়ার পথে তিনি নিউইয়র্কে থামতেন; কোনো কোনোবার ক্যালিফোর্নিয়া থেকে তিনি নিউইয়র্কে আসতেন। এসেই যোগাযোগ করতেন; দিনক্ষণ ঠিক করা হতো মধ্যাহ্নভোজের। আমার দপ্তরের অনতিদূরে একটি ভূমধ্যসাগরীয় রেস্তোরাঁ ছিল; বেশ নির্জন, কথাবার্তা বলার জন্য উত্তম। স্যার একটু বেলা করে ৩টার দিকে আসতেন। নিচ থেকে ফোন দিলে আমি নেমে আসতাম। স্যার কখনও আমার দাপ্তরিক কক্ষে আসেননি। আমি নেমে এলে আমরা হেঁটে হেঁটে গল্প করতে করতে ওই রেস্তোরাঁয় যেতাম। স্যার প্রথমেই বেনুর খবর নিতেন; ওর ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হতেন। ওর প্রথম অস্ত্রোপচারের সংবাদ শুনে বেনুকে তিনি একটি মায়াময় চিঠি লিখেছিলেন। 

রেস্তোরাঁয় পৌঁছে কোনার দিকের বাগানমুখী একটা টেবিলে বসতাম দু’জনে। বাইরে তেরছা রোদ, দু’একটা পাখির কিচিরমিচির শোনা যেত। গল্প জমে উঠতে সময় লাগত না। প্রায়শ রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে কথা শুরু হতো। স্যার তখন তাঁর ‘অসীমের স্পন্দ’ বইটি লিখছেন। বিভিন্ন সময়ে নিউইয়র্কে দেখা হওয়ার কালে সে গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি দেখাতেন; মতামত চাইতেন আমার। একবার তাঁর স্বকণ্ঠে ধারণকৃত রবীন্দ্রসংগীতের একটি ক্যাসেট আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। সেটি এখনও আমার কাছে সংরক্ষিত। একবার আফ্রিকার সংগীত সম্পর্কে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সেখানে সেলিফ ক্যাইতা থেকে উমে সাঙ্গারি, বাবা মাল থেকে সিজোরা অ্যাভোরা পর্যন্ত আলোচনা ছিল। খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি; বিরূপাক্ষ (ড. বিরূপাক্ষ পাল) পরে আমাকে জানিয়েছিল। কোনো এক বর্ষণমুখর বিকেলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভেতরে দাঁড়িয়ে তিনি বিরূপাক্ষকে সে কথা বলেছিলেন।

একবার এক মজার ঘটনা ঘটেছিল এবং সেই একবারই অর্থনীতি আমাদের আলোচনার বিষয় হয়েছিল। অধ্যাপক আনিসুর রহমানের সঙ্গে দেখা করার জন্য চিরায়ত নিয়মে আমার দপ্তর কক্ষ থেকে নিচে নেমে এসে আমি অবাক হয়ে দেখলাম, স্যারের হাতে অর্থনীতির একটি  চিকন বই– অধ্যাপক ভবতোষ দত্তের ‘ভারতে অর্থনৈতিক চিন্তার বিকাশ’। তিনি সহাস্যে বললেন, ‘এত বড় একজন অর্থনীতিবিদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, একটু তৈরি না হয়ে তো আসতে পারি না’। তাঁর কথায় আমি শুধু অপ্রতিভই হইনি, খুব লজ্জা পেয়েছিলাম।
‘মানব উন্নয়ন সূচক’ নিয়েও অধ্যাপক আনিসুর রহমান তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। সে নিয়ে আমাদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। বহু বিষয়ে আমরা একমত হতে পারিনি। কিন্তু তাঁর মেধা, মনন এবং জ্ঞানের কাছে আমি প্রতিনিয়ত নমিত হই। 

রোববার চলে গেলেন আমার শিক্ষক অধ্যাপক আনিসুর রহমান। বহুদিন দেখা হয়নি তাঁর সঙ্গে। বছর ২০ আগে ঘরোয়া পরিবেশে তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতের একটি ক্যাসেট তিনি আমাকে উপহার দিয়েছেন। আজ রাতে ঘরের সব বাতি নিভিয়ে চুপ করে শুনব তাঁর গান।

সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র 
 

আরও পড়ুন

×