ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি

১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারে ইসির সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক

১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারে ইসির সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ০৯:৩৬ | আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ০৯:৩৬

রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াই আগামী সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন দেশের ৩৯ বিশিষ্ট নাগরিক। মঙ্গলবার এক যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা বলেছেন, ইসির এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিতর্ককে আরও উস্কে দেবে এবং কমিশনের বর্তমান আস্থার সংকটকে আরও প্রকট করে তুলবে। আবারও একটি ব্যর্থ নির্বাচনের কবলে পড়ে জাতি চরম সংকটের দিকে ধাবিত হবে।

বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, প্রযুক্তিগতভাবে ইভিএম একটি দুর্বল যন্ত্র। এতে 'ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল' (ভিভিপিএটি) নেই। ফলে কমিশন ঘোষিত ভোটের ফলই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। ইভিএমে ভোট পুনঃগণনা বা নিরীক্ষার সুযোগ নেই। এ কারণে ইসির কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১৮ সালে ইভিএম কেনার সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি।
এতে বলা হয়, প্রযুক্তির কারণে ইভিএম ব্যবহার করে ডিজিটাল জালিয়াতিও করা যায়। বায়োমেট্রিকভিত্তিক ইভিএম অনেক ভোটারকেই শনাক্ত করতে পারে না। ফলে কমিশন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের তাঁদের আঙুলের ছাপ দিয়ে যন্ত্রটি খুলে দেওয়ার (ওভাররাইড) ক্ষমতা দিয়ে থাকে। যে কোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মতো প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে ইভিএমের ফলাফল নিয়েও কারসাজি করা যায়। এ ছাড়া নির্বাচনের সময়ে মাঠ পর্যায়ে নিয়োজিত কারিগরি টিমও নির্বাচনী ফল বদলে দিতে পারে। গত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর হাঙ্গামা হলে ফল পাল্টে দেওয়া হয়। এটা কেবল ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমেই সম্ভব।
বিবৃতিতে বলা হয়, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। কমিশনের ডাকা সংলাপে অংশ নিয়ে ১৪টি দল এ নিয়ে তাদের সংশয় ও সন্দেহের কথা স্পষ্টভাবেই বলেছে। এর মধ্যে ৯টি দল সরাসরি ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছে। আওয়ামী লীগসহ চারটি দল ইভিএমে ভোট চেয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপিসহ যে ৯টি দল ইসির সংলাপ বর্জন করেছিল, তারাও ইভিএমের বিপক্ষে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেও সংলাপের সময়ে বলেছিলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না। তাই ইভিএমের ওপর অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের এ অবিশ্বাস আগামী নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করার পথে একটি বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে বিবৃতিতে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিগত সংসদ নির্বাচনের আগে ইভিএম কেনায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার (৪৫০ মিলিয়ন ডলার) মতো ব্যয় হয়েছে। ১৫০টি ইভিএমে নির্বাচন করতে হলে নতুন মেশিন কেনায় অন্তত অর্ধ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এ ধরনের বিপুল ব্যয় কতটুকু যৌক্তিক তা ভেবে দেখার অনুরোধ জানান তাঁরা।
এতে বলা হয়, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও ভোটারদের আস্থাহীনতার কারণে বিশ্বের অনেক দেশই এখন ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে আসছে। প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক উন্নত জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসও ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। পৃথিবীর ১৭৮টির মধ্যে বর্তমানে শুধু ১৩টি দেশ তাদের সব নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করছে।
বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেন, ইভিএম ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা দূর না করেই এই সিদ্ধান্ত আগামী নির্বাচন নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হবে। আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কের ক্ষেত্র তৈরি করবে। তাই নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানানো হয় বিবৃতিতে।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন- সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান ও ড. আকবর আলি খান, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক পারভীন হাসান, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক, অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আলোকচিত্র শিল্পী ড. শহিদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমতুল্লাহ, আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, লেখক অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, সাধনার আর্টিস্টিক ডিরেক্টর লুবনা মরিয়ম, লন্ডনের সোয়াস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও গবেষক স্বপন আদনান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সিনিয়র সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, সাংবাদিক কামাল আহমেদ, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন, নারীপক্ষের সদস্য শিরিন হক, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, অস্ট্রেলিয়ান পাবলিক সার্ভিসের সাবেক সিনিয়র তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সাইফুর রহমান, আর্টিকেল ১৯-এর আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী, মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ ও সিনিয়র সফটওয়্যার সলিউশন আর্কিটেক্ট ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।

আরও পড়ুন

×