অসীম মমতায়

বাবা প্রিয়দর্শন চৌধুরীর সঙ্গে রূপালী চৌধুরী
রূপালী চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড
প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৪ | ১০:৩৩ | আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪ | ১৮:২৪
আমার বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বিভাগের পটিয়া উপজেলায়। ওই সময়ে জায়গাটা একটা ছোট শহর ছিল। আমার ছোটবেলা ছিল খুবই মধুর। আমরা পাঁচ ভাই-বোন ও আমাদের বাবা-মা নিয়ে খুবই সুখী এক পরিবার ছিল। আমাকে কেউ এখনও যদি প্রশ্ন করে যে, আমার জীবনের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি কী– আমি নির্দ্বিধায় বলি পটিয়ায় আমার বেড়ে ওঠার দিনগুলো। আমার বাবা প্রিয়দর্শন চৌধুরী পেশায় একজন চিকিৎসক ছিলেন। আমার দাদুর ব্যবসাসূত্রে বাবার লেখাপড়া দেশের বাইরে হয়। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তিনি তৎকালীন বার্মায় (বর্তমানে মিয়ানমার) একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়েছেন, পরে ভারতে পাড়ি জমিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা মেডিকেল কলেজ এবং অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সে (এআইআইএমএস) পড়াশোনা করেন। ১৯৫৭ সালে মায়ের (আমার ঠাকুমার) ডাকে পটিয়ায় ফিরে আসেন এবং এখানে একটি প্যাথলজি সেন্টার খুলে জেনারেল প্র্যাকটিশনার (জিপি) হিসেবে চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেন। ভিজিট ছিল মাত্র দুই টাকা। এর পাশাপাশি তিনি স্বেচ্ছায় পটিয়া কলেজে জীববিজ্ঞান পড়াতে শুরু করেন। তাঁর প্রিয় বিনোদন ছিল ফুটবল। এমনকি তিনি স্বেচ্ছায় স্থানীয় ফুটবল খেলায় রেফারিংও করতেন।
বাবা যেহেতু মুক্তমনা ছিলেন, তিনি সন্তানদের জ্ঞান অর্জন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনুশীলন করার জন্য বিভিন্ন মাধ্যম এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে উন্মোচিত এবং নিমজ্জিত হওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তিনি বাড়িতে এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করেছিলেন যে, আমরা আমাদের মনের মধ্যে যা কিছু চলছে তা কোনো ভয় ছাড়াই স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারতাম। তাই বাড়িটিও আমাদের জন্য একটি শিক্ষার জায়গা ছিল। ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য বা কথাসাহিত্য– যে বিষয়েই হোক না কেন; আমার বাবা নিশ্চিত করেছিলেন, আমরা যতটা সম্ভব বিশ্ব সম্পর্কে জানি। তাঁর এই মুক্তমনা চিন্তা আমাদের একটি বিশ্বব্যাপী মানসিকতা এবং চিন্তা প্রক্রিয়ার দিকে পরিচালিত করেছিল, যা জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে অনেক সাহায্য করে। কেউ এমন পরিবেশে বেড়ে উঠলে নিশ্চিতভাবেই আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবেন।
বাবা খুব দয়ালু ছিলেন। এলাকায় সবাই তাঁকে অনেক শ্রদ্ধা করত, তাই সবার অনুরোধে তিনি এলাকার মেম্বার হন। আমার এখনও মনে আছে, ’৭০-এর সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের ভাইবোনসহ তিনি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন দুর্যোগকবলিত প্রত্যন্ত এলাকায়। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। পরবর্তীকালে তাঁকে মরণোত্তর গোল্ড মেডেলও দেওয়া হয়।
বাবা আমার অনেক ভালো বন্ধু ছিলেন। আমি এখনও বলি, আমি জীবনে যত কিছু অর্জন করেছি, এতে আমার বাবার অবদান অনস্বীকার্য। বাবা খুব স্পষ্টভাষী ছিলেন। বিশ্বাস করতেন যে, শত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সর্বদা সত্য বলা উচিত এবং এভাবেই পরিবর্তন আসবে। আমি তাঁর কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি যা শিখেছি, তা হলো– সাহস রাখা, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন।
২০০৮ সালে তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে পরলোক গমন করেন। তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার মতো কিছু যদি আমার বলতেই হয়, তাহলে তা হবে ইচ্ছাশক্তি, শৃঙ্খলা, সততা, সাহস এবং দৃঢ় কাজের নীতি। এই শিক্ষাগুলো আমি আজও মেনে চলার চেষ্টা করি। এর মাঝেই আমি আমার বাবাকে খুঁজে পাই।
- বিষয় :
- বাবা