কেমন মা আপনি?

ছবি :: বোরহান আজাদ
আফরোজা চৈতী
প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১০:৫৩ | আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৬:৫৯
মায়েদের এক নিয়মিত অভিযোগ, বাচ্চা কথা শোনে না। বিশেষ করে ৫ বছর থেকে ১৬ বছর বয়সের বাচ্চাদের মানানো যেন এক বিশাল যুদ্ধ। স্কুলে যাবার সময় স্কুলে যাবে না, খাবার সময় খাবে না, সারাক্ষণ ট্যাব বা ফোন নিয়ে বসে থাকবে, পড়ার সময় পড়তে বসবে না।
আচ্ছা, আপনি কখনও ভেবে দেখেছেন, মা হিসেবে আপনি আপনার বাচ্চাকে কী ধরনের প্যারেন্টিং-এর দিকে নিয়ে যাচ্ছেন? আপনি কি একজন ডোমিনেটিং প্যারেন্ট, নাকি কেয়ারলেস প্যারেন্ট? নাকি ওভার পজেসিভ প্যারেন্ট?
শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত আমরা ভেবেই নিই, আমরা যে সিদ্ধান্তগুলো বাচ্চার ক্ষেত্রে নেব, সেটিই ঠিক। কারণ, আমার চেয়ে আর বেশি ভালো কে বুঝবে? অথচ শিশুমনোবিদরা বলছেন, আপনার শিশুর এক বছর বয়স থেকে তাকে একজন আলাদা মানুষ হিসেবে ট্রিট করতে হবে। আপনি বাইরে যাবার সময় লাল ও হলুদ দুটো জামার অপশন তাকে দিন। সে লোফার পরবে না স্যান্ডেল পরবে সেই সিদ্ধান্তটি তাকেই নিতে দিন। অথচ আপনি বলছেন, ওইটুকু মানুষের আবার কী পছন্দ? আমার পছন্দই ওর পছন্দ। আমি বলছি, ও লালজামা পরবে, অথচ ওর হয়তো সাদাটাই পছন্দ। বাচ্চার ব্যক্তিত্ব গঠনে তার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার চর্চাটা ভীষণ জরুরি। এই গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টিই আপনাদের মধ্যে এক দারুণ বন্ধুত্ব তৈরি করে দিতে পারে।
আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাচ্চার বস্তুগত প্রয়োজন মিটিয়ে আপনি ভাবছেন তার সব ধরনের দায়িত্ব শেষ করছেন। হয়তো আপনি কর্মজীবী মা, তাই দিনশেষে বা ছুটির দিনে বাচ্চাকে দামি গিফট দিয়ে ভাবছেন দায়িত্ব শেষ! সব সম্পর্কের মতো বাচ্চার সঙ্গে রয়েছে আপনার একটি আবেগের সম্পর্ক। আপনাকে অবশ্যই তার জন্য কোয়ালিটি সময় বের করতে হবে। যে সময়টা আপনি তার সঙ্গে আপনার সারাদিন কেমন কেটেছে, এই সবকিছুই শেয়ার করবেন, গল্পচ্ছলে তার সঙ্গে আপনার একটি চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। অথচ সেটি না করে যদি সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে সে কেন পড়ছে না, সে কেন মোবাইল নিয়ে আছে, সে কেন বন্ধুদের সঙ্গে এত সময় আড্ডা দিচ্ছে– এসব নিয়ে বকাবকি করেন, পরিস্থিতি হিতে বিপরীত হবে। আপনাকে আপনার সন্তানের হৃদয়ের কথা বুঝতে হবে।
আপনি হয়তো আপনার বাচ্চাকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে চাইছেন; তার আগে আপনাকে সে কী চাইছে, কী ভাবছে, তা বুঝতে হবে। আপনাকে বুঝতে হবে এবং মেনে নিতে হবে আপনার গর্ভ থেকে জন্ম বলেই সে আপনার পছন্দের ক্রীতদাস না; বরং আপনার সন্তান; একজন আলাদা ব্যক্তি। তার ব্যক্তিত্ব তৈরি হবে শিশুকাল থেকেই, সেটা নস্যাৎ হতে পারে আপনার কেয়ারলেস বা ডোমিনেটিং প্যারেন্টিং-এর মাধ্যমে।
এক ধরনের প্যারেন্ট আছেন, যারা হলেন ওভার পজেসিভ। তাদের বেশির ভাগই গৃহিণী এবং সন্তানের সবকিছুই তারা নিজে করেন। সেটি যদি তাদের শারীরিক কষ্ট বা অসুস্থতার জন্য বিছানায় শয্যাশায়ী হতে হয় তাও তারা সন্তানের কোনো কিছুতে কাউকে নাক গলাতে দেন না। এই মায়েরা সন্তানের সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক কথা নিতে পারেন না। এটি ভীষণ নেতিবাচক প্যারেন্টিং। এর মাধ্যমে যে বাচ্চার মধ্যে অতিআত্মবিশ্বাস অথবা আত্মবিশ্বাসহীনতা দেখা দেয়; যা পরবর্তী সময় পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারেও মোড় নিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অথরিটেটিভ প্যারেন্টিং সবচেয়ে নিরাপদ প্যারেন্টিং। এ ধরনের প্যারেন্টিংয়ে বাচ্চাদের সিদ্ধান্তকে বড়দের সিদ্ধান্তের মতোই প্রাধান্য দেওয়া হয়, তার মতামতের মূল্য দেওয়া হয়, বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের চিন্তা, আবেগ ও মূল্যবোধের একটি সেতুবন্ধ তৈরি হয়। সন্তান যখন কোনো কিছুতে না বলে, তখন তারা প্যারেন্টিং ইগো না দেখিয়ে তাদের সঙ্গে কানেক্ট করার চেষ্টা করেন এবং বোঝার চেষ্টা করেন কেন সন্তান না বলছে। যে কোনো ভুল আচরণের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে তারা সন্তানের মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করেন।
আপনি সবচেয়ে বড় নির্ভরতার আশ্রয় এই বোধটি যখন সন্তানের ভেতর আসবে, তখন সে আপনার কাছে থেকে কোনো কিছু না লুকিয়ে আপনার কাছে সত্য কথাটা বলবে। সেটি যদি অপ্রিয় কোনো সত্য কথা হয় তাও বলবে। আপনাকে তার আস্থার, নির্ভরতার জায়গায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। যেখানে সে যেমন সবকিছু খুলে আপনাকে বলতে পারে তেমনি আপনিও তাকে সরাসরি কথাটা জিজ্ঞাসা করবেন। একটি সুস্থ সম্পর্কের চিহ্ন হলো– যখন কেউ তার ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে আপনার মমতাকে অনুভব করতে পারে। আর তখন সে কখনোই চুপ থাকবে না; বরং আপনাকে তার সব কথা বলবে। মা হিসেবে আপনাকেও তখন আপনার সন্তানের আবেগ. মতামত, চাওয়া-পাওয়ার জায়গা বুঝে তাকে কারেক্ট করতে হবে। সন্তানের প্রতি আত্মবিশ্বাস রাখুন, তাকে মূল্য দিন। এই ছোট ছোট প্যারেন্টিং কৌশলই আপনার সন্তানকে ক্ষমতায়িত করবে, আত্মবিশ্বাসী করবে এবং জীবনযুদ্ধে তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে।
- বিষয় :
- সন্তান
- প্যারেন্টিং