আইনি কাঠামোতে সংস্কার দরকার

সালমা আলী
সালমা আলী
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৯ | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১১:৪৮
আমাদের দেশে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের বৈধ অভিভাবক তার বাবা। মা-বাবা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ছেলেদের ক্ষেত্রে ৭ বছর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়োপ্রাপ্ত বা ১৬ বছর হওয়া পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকতে পারবে। এ সময়েও কিন্তু মা হবেন জিম্মাদার। বাবা হবেন ওই সন্তানের বৈধ অভিভাবক।
২০১১ সালে বিচারপতি মুহাম্মদ ইমান আলী এক রায়ে বলেছেন, বাদী আনিকা আলী ও বিবাদী রেজওয়ানুল আহসান ২০০২ সালের ২৩ ডিসেম্বর মুসলিম আইনের অধীনে বিয়ে করেন। ২০০৩ সালে তাদের সন্তান ফারজান আহসানের জন্ম হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। ২০০৫ সালে আনিকা আলী বিয়ে বিচ্ছেদের মামলা করেন। রেজওয়ানুল আহসান পরে আরেকটি মামলা করেন সন্তানকে নিজের জিম্মায় চেয়ে। আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের জন্য যা সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করবেন, আদালত সেই সিদ্ধান্তই নেবেন। ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে ৭ বছর মায়ের জিম্মায় থাকার কথা বলা হলেও এর পরও যদি আদালত মনে করেন, সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য মায়ের কাছে থাকা দরকার, তাহলে আদালত সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অর্থাৎ, আইনে যা-ই বলা থাকুক না কেন, আদালত এর বাইরে গিয়েও রায় দিতে পারেন। সেই রায় আইন হিসেবে গণ্য হবে।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ছেলের সাত বছর হওয়ার পর বাবার কাছে গেল; কিন্তু সেখানে সৎমা অত্যাচার করেন। এমন ক্ষেত্রে আদালত সন্তানকে মায়ের হেফাজতে দিয়েছেন। আবার কখনও খালা বা দাদির হেফাজতেও দেওয়া হয়। শিশুর স্বার্থকে ঊর্ধ্বে রেখে আদালত বিভিন্ন সময়ে প্রেক্ষাপট বিচারে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তবে আইনে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মায়ের স্বীকৃতি নেই।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক গুরুত্বপূর্ণ রায় দেন। ওই রায় অনুযায়ী, শিক্ষা সনদে বাবার নাম লেখা বাধ্যতামূলক নয়। শিক্ষা সনদের জন্য ফরম পূরণের ক্ষেত্রে আগে শুধু ‘বাবার নাম’ ব্যবহার করা যেত। এই রায়ের ফলে এখন থেকে বাবার নামের পাশাপাশি আরও দুটি অপশন যুক্ত হলো। এতে করে কেউ চাইলে বাবার পরিচয় ব্যবহার না করেও শিক্ষা সনদ পেতে ফরম পূরণের সময় মা কিংবা আইনগতভাবে বৈধ অভিভাবকের নাম লিখতে পারবেন। তবে এটি শুধু শিক্ষা সনদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অন্য কোনো কাজে নয়।
সংবিধানে স্পষ্ট করে নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হয়েছে। তবে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত আইনের ক্ষেত্রে নিজ নিজ ধর্মীয় আইনের কথা বলা হয়েছে। হিন্দু নারীর ক্ষেত্রেও অভিভাবকত্বের কোনো বিধান নেই। তাদের এমনকি বাবা বা স্বামীর সম্পত্তিতে অংশীদারির অধিকার নেই। অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের সম্পত্তিতেও মায়ের অধিকার থাকে না; কারণ সন্তানের বৈধ অভিভাবক তিনি নন। ভারত, নেপালসহ অনেক দেশে এসব আইনে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। নারীকে বৈধ অভিভাবক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে মা-বাবা দু’জনই সন্তানের অভিভাবক। আমরা এখন সংবিধান সংস্কারের কথা বলছি। এই বৈষম্যমূলক আইনগুলোরও মৌলিক সংস্কার জরুরি।
উচ্চ আদালতে এমন কয়েকটি রায় রয়েছে, যেখানে মাকে সন্তানের অভিভাবক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানে বলা আছে, উচ্চ আদালতের রায় আইন বলে গণ্য হবে। এখন আমাদের কাছে সুযোগ আছে, এসব রায়ের আলোকে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইনগুলো পরিবর্তন করার। বাস্তবতার তাগিদেই আমাদের আইনি কাঠামোয় সব বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি
- বিষয় :
- নারী
- প্যারেন্টিং
- আইন