ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন

নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ

নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন

অলংকরণ :: বোরহান আজাদ

 শাহীন রহমান

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৮ | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ১১:৩৪

প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রতিটি প্রান্ত থেকে লাখ লাখ মানুষ নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনের প্রচার-প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে থাকেন। এ প্রচার অভিযানের মূল লক্ষ্য হলো– সবাইকে এ কথা জানানো যে নারীর অধিকার মানে মানবাধিকার, নারী নির্যাতন মানে মানবাধিকার লঙ্ঘন। নারীর প্রতি সহিংসতার কুফল ভোগ করতে হয় ধর্ম-বর্ণ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মানুষকেই। এ উপলব্ধি থেকে ১৬ দিনের প্রচার অভিযানে সমাজের প্রত্যেক মানুষকে একত্রে কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। 

নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ উদ্ভবের পেছনে রয়েছে এক সংগ্রামী আত্মত্যাগের ইতিহাস। লাতিন আমেরিকার ডমিনিকান রিপাবলিকের ফ্যাসিস্ট শাসকের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে ১৯৬০ সালে। ওই বছরের ২৫ নভেম্বর এ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী তিন বোন প্যাট্রিয়া, মারিয়া তেরেসা ও মিনার্ভা মিরাভেলকে হত্যা করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৮১ সাল থেকে এ দিনটি অর্থাৎ ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে। 

১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ ২৫ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ পক্ষ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রচার অভিযান মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালে। সে বছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ২৩ জন নারী যখন যুক্তরাষ্ট্রের উইমেন্স গ্লোবাল লিডারশিপ ইনস্টিটিউটে একত্র হয়েছিলেন, তখন তারা ভাবতেই পারেননি যে একসময় নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষ জড়ো করার হাতিয়ার হিসেবে এ কর্মসূচি অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জন করবে। তারা ২৫ নভেম্বরকে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে দিবস এবং ১০ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘ তাদের এ উদ্যোগকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।

এ প্রচার অভিযান যে বিষয়টিতে সবচেয়ে জোর দেয় তা হচ্ছে– ধর্ম, বর্ণ, পেশা, রাজনৈতিক পরিচিতি, সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সব মানুষেরই নারী নির্যাতন বন্ধে ভূমিকা রাখার প্রয়োজন রয়েছে। নারী নির্যাতনকে ব্যক্তিগত সমস্যা মনে করে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আমাদের সবারই কিছু না কিছু করার আছে। কারণ এর ভুক্তভোগী পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। আমরা যদি নারী নির্যাতনমুক্ত সুস্থ সমাজ চাই তবে মনে রাখতে হবে, নিজে নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকাটাই যথেষ্ট নয়; বরং আশপাশে ঘটে যাওয়া যে কোনো নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে হবে। কারণ নারী নির্যাতনকে টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বেশি দায়ী আমাদের নীরবতা। 

১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে নারীবিষয়ক চতুর্থ বিশ্ব সম্মেলনে পৃথিবীর সব দেশের সরকারের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছিলেন এবং তারা যৌথভাবে ‘বেইজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন’ গ্রহণ করেন। অথচ এ যাবতকালে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অগ্রগতি হয়েছে খুব সামান্যই। বিশেষ করে নারী নির্যাতন রোধে পর্যাপ্ত বরাদ্দ, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা, ইতিবাচক আইনের প্রয়োগ এবং জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের ব্যাপারে সরকারের জবাবদিহির ওপর বিশেষ জোর দেওয়া প্রয়োজন। 

সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা সরকারের কোনো দয়া-দাক্ষিণ্যের ব্যাপার নয়। বরং সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগে (যেমন সিডও, বেইজিং ঘোষণা) স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রতিটি রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা বাধ্য। রাষ্ট্রের রক্ষক হিসেবে এ দায়-দায়িত্ব বহন করবে সরকার। রাষ্ট্র যখন তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তখন সরকারকে অবশ্যই এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তবে সরকারই এককভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সামাজিক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, করপোরেশনগুলোও জবাবদিহির আওতায় পড়ে। এমনকি প্রচলিত রীতিনীতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির যে দিকগুলো নারীকে অবদমিত করে রাখে, সেগুলোকেও শক্তভাবে প্রতিহত করতে হবে, চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে হবে। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে ভূমিকার জন্য আমরা সবাই দায়বদ্ধ।

বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের যে ধরনগুলো সবচেয়ে ব্যাপক তা হচ্ছে যৌতুকের জন্য সহিংসতা, শারীরিক নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, পাচার, বাল্যবিয়ে, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করা, যৌন হয়রানি, রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্ত করা। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় ইউএনএফপিএ’র পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, প্রতি দু’জন নারীর মধ্যে একজন নির্যাতনের শিকার হন। ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় পারিবারিক নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি। ৬০ শতাংশ নারীই বিবাহিত জীবনে স্বামী দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন। 

নারীর প্রতি সহিংসতার যে চিত্র প্রকাশ্যে আসে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এর বাইরেও প্রচুর সহিংসতার ঘটনা পরিবারে ও সমাজে অলক্ষ্যে রয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ছোটখাটো ঘটনাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়, কিংবা পরিবারের পক্ষ থেকেও ঘটনা লুকিয়ে ফেলা হয়। 

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের দেশে বেশ কিছু আইন রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতার অভাবে কিংবা আইনের ফাঁকফোকরের কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এর ফলে একদিকে যেমন অন্য অপরাধীরা উৎসাহিত হয়, অন্যদিকে নির্যাতিত নারীরাও আইনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কিছু কিছু নির্যাতনের ক্ষেত্রে আইনের অভাবও নারী নির্যাতনের জন্য দায়ী। বাংলাদেশে পারিবারিক নির্যাতন বিষয়ে আলাদা কোনো আইন নেই। পারিবারিক নির্যাতনের ফলে যদি কোনো নারী গুরুতর জখম হন, সেটি প্রমাণ করা সম্ভব কিন্তু মানসিক আঘাত প্রমাণ করা খুব কঠিন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনকে উল্লেখ করে পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে একটি আলাদা আইন থাকলে এ অপরাধের শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা যেত। উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া ও নেপালে পারিবারিক নির্যাতন বিষয়ে আলাদা আইন রয়েছে। 

একজন বিবাহিত নারী যদি তাঁর স্বামী অথবা স্বামীর আত্মীয়দের নিষ্ঠুর আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করেন; তবে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার বিশেষ কোনো ধারা দণ্ডবিধিতে নেই। একইভাবে একজন পুরুষ যদি বিয়ে করার আশ্বাস দিয়ে কোনো নারীর সঙ্গে সহবাস করেন এবং এর ফলে যদি ওই নারী অন্তঃসত্ত্বা হন বা সন্তান জন্ম দেন, কিন্তু পরে পুরুষটি বিয়ে করতে না চাইলে বা সন্তানটির পিতৃত্ব অস্বীকার করলে প্রচলিত দণ্ডবিধি অনুযায়ী তাঁকে শাস্তি দেওয়ার কোনো বিধান নেই। সমাজ, লোকলজ্জা বা পারিবারিক সম্ভ্রমহানির ভয়ে নারীরা এ ধরনের নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করেন। 

সরকার সুবিচার নিশ্চিত করতে অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ করার জন্য যথেষ্ট ক্ষমতা বা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইনের উপস্থিতির পাশাপাশি এর প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য চাই ইতিবাচক মানসিকতা এবং নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার জন্য উন্নত মূল্যবোধ। নারীদের ভাঙতে হবে নীরবতা। নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে হবে, তা সে পরিবারেই হোক কিংবা সমাজে। 

নারী নির্যাতন বন্ধে করণীয় হিসেবে ইদানীং যে বিষয়টি বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হচ্ছে নারী নির্যাতন বন্ধে কেবল নারীর সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, বরং পুরুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, নারী নির্যাতনের মাশুল শুধু নারীরাই দেন না– গোটা পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রকেও পিছিয়ে পড়তে হয় অনেক। যে পরিবারে নারী নির্যাতন হয় সে পরিবারের শিশুরা শিক্ষা-দীক্ষা ও সামাজিকভাবে অনেক পিছিয়ে পড়ে। নারী নির্যাতনের অর্থনৈতিক খেসারতও কম নয়। নরওয়ে, সুইজারল্যান্ডের মতো দেশগুলোর মাথাপিছু আয় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি হওয়ার একটি অন্যতম প্রধান কারণ– ওইসব দেশে নারী নির্যাতনের হার কম। তাই সেখানে নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমানতালে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারেন আর পরিবার ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে রাখতে পারেন সমান অবদান।

লেখক: রাজনৈতিক কর্মী ও গবেষক

আরও পড়ুন

×