ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

সুলতানাদের স্বপ্ন

সুলতানাদের স্বপ্ন

‘কথা বলো নারী’র আয়োজনে রোকেয়া দিবস উপলক্ষে গত ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অনুষ্ঠিত হলো ‘সুলতানাদের স্বপ্ন-২০২৪’

তাসমিয়া জাহান সিমরান

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:০৫ | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১২:০৪

একুশ শতকে এসেও পৃথিবীতে নারী নিরাপদ নন; বরং বৈষম্যের শিকার। এখনও নারীর কথা বলার অধিকারের জন্য জোরেশোরে আয়োজন করতে হয়। এমনকি নারী যেন নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলার আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছেন কিংবা সমাজে চলমান পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো নারীকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যে তিনিও যে কথা বলতে পারেন, সেটিই যেন তাঁর মনে থাকে না। আমাদের পরিবার কাঠামোতেও নারীকে শৈশব থেকে কথা কম বলার অভ্যাস করতে বলা হয়। নারীর কথা শুনতে অভ্যস্ত না থাকার কথাও জানান অনেক পুরুষ। 

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চিত্র ছিল ঠিক এই বাস্তবতার বিপরীত। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ৬০-৭০ শতাংশ ছিলেন নারী। এই আন্দোলনের একটা বড় অংশ মায়েরা, যারা সন্তানের হাত ধরে নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। কিন্তু ৫ আগস্টের বিজয়ের পর নারীর অংশগ্রহণকে উপেক্ষা করা শুরু হয়। এমনকি নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনও ছাড় পাননি। পুরুষতন্ত্রের অবশ্য রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে ভয় পাওয়ার একটা বিশেষ কারণ আছে। রোকেয়া নারীশিক্ষার পথ উন্মোচন করেছিলেন। সে পথ ধরেই এ দেশের মেয়েরা আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। এমনকি ফ্যাসিস্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। তাই রোকেয়াকে ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। সেই ভয় থেকেই আসে আক্রমণ। এত সব বাস্তবতার মধ্যেই জন্ম ‘কথা বলো নারী’ নামে প্ল্যাটফর্মের। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে পরিচিত মুখ নুসরাত হক এবং আরও কয়েকজন নারীর উদ্যোগে এটি শুরু হয়েছে। উদ্দেশ্য, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারীর কথা বলার একটা পরিসর তৈরি করা। যে পরিসরে নারী কথা বলতে পারবেন, অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারবেন এবং নিজের অধিকার নিয়ে সচেতন হবেন। 

‘কথা বলো নারী’র আয়োজনে রোকেয়া দিবস উপলক্ষে গত ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো ‘সুলতানাদের স্বপ্ন-২০২৪’। মজার ব্যাপার হলো, উপস্থিত এক-তৃতীয়াংশ অতিথি ছিলেন পুরুষ। উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী– উদ্যোক্তা, শিক্ষার্থী, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যাংকার, রাজনৈতিক কর্মী এমনকি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দু’জন উপদেষ্টাও। অধিকাংশই জুলাই আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী। উপস্থিত নারীরা তাদের অভিজ্ঞতা ও স্বপ্নের কথা তুলে ধরেন। আন্দোলনের শুরুর দিক থেকে সরব এবং স্লোগানের জন্য বেশ পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থী সীমা আক্তারও উপস্থিত ছিলেন এ আয়োজনে। সীমা বলেন, “ইতিহাসে নারীর ভূমিকা সর্বদাই অবহেলিত। মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা বা বীরত্বগাথা অপ্রচারিত। ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে সব অপপ্রচার, অনলাইন বুলিং রুখে দিয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও নারীর কণ্ঠ আজ উপেক্ষিত, নারীকে শহীদ হিসেবেও স্বীকার করতে চান না অনেকে। নারীকে নিজেই নিজের কথা বলতে হেবে। সব বিভাগে নারীর প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি করতে হবে। সমান সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”

আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন উদ্যোক্তা তাহমিনা শৈলী। মূলত গহনার ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘নারীর কাজই তাঁর শক্তি।’ এ ছাড়া নারীর ঋণ সুবিধা কীভাবে পুরুষের দ্বারা অপব্যবহৃত হয়, সে বিষয়েও আলোকপাত করেন তিনি।

আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের সময় নারীকে মিছিলের সামনে রাখা হতো যেন পুলিশ আক্রমণ না করে। নারীকে আন্দোলনের ভ্যানগার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ এখন নারীকে প্রাপ্য স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না।’ এ ক্ষেত্রে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারী ও পুরুষের তুলনামূলক মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন বলেও তিনি মনে করেন। 

আয়োজনে উপস্থিত মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীকে এখনও বধূবেশে দেখার মনস্তত্ত্ব রয়ে গেছে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার তেমন কোনো লক্ষণীয় উদ্যোগ নেই। এমনকি আধুনিক দেশগুলোতেই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা হতে ২৫০ বছর সময় লেগে গেছে। এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে পুঁজিবাদের সম্পর্ক।’

‘সুলতানাদের স্বপ্ন’ আয়োজনে উপস্থিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ বলেন, ‘এ ধরনের একটি উদ্যোগ আসলেই প্রশংসনীয়। সরকার থেকে উদ্যোগ নিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীর তালিকা আগামী দুই মাসের মধ্যেই প্রস্তুত করা হবে।’ ১৯৭১-এর মতো ’২৪-এর গণআন্দোলনে নারীর বীরত্বগাথা যেন হারিয়ে না যায়, সে জন্য ডকুমেন্টারি নির্মাণ, ছবি ও ভিডিও আর্কাইভ, প্রকাশনাসহ অন্যান্য উদ্যোগকেও তিনি স্বাগত জানান।

মতবিনিময়ের পাশাপাশি এ আয়োজনে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারীর অংশগ্রহণের সাহসিকতার চিত্র প্রদর্শনী এবং ‘অভ্যুত্থানের নারীরা’ শীর্ষক একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্রও প্রদর্শন করা হয়। ‘কথা বলো নারী’র আহ্বায়ক নুসরাত হক বলেন, ‘‘কথা বলো নারী এমন উদ্যোগ বারবার নেবে এবং নারীর কথা বলার নির্ভরযোগ্য পরিসর হয়ে উঠবে। সে উদ্যোগ সফল হলে সুলতানাদের স্বপ্ন দেখার আরও অনেক দুয়ার খুলে যাবে। নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাবলম্বিতা এবং বিভিন্ন খাতের সংকট নিয়ে কথা বলার মধ্য দিয়ে সমাধানের পথ খুঁজে বের করার লক্ষ্যেই এই প্ল্যাটফর্ম। নারী হওয়ার কারণে বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হতে এ ধরনের একটা চিন্তা মাথায় ঘুরছিল বহুদিন ধরে। ৫ আগস্ট সব সীমাবদ্ধতা, প্রতিবন্ধকতা ভেঙে ফেলেন জুলাই অভ্যুত্থানের লড়াকু নারীরা। আন্দোলনের পর যখন দেখছিলাম নারীরা আবারও সামনের কাতারে লড়াই থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন, তখনই কয়েকজন বসে সিদ্ধান্ত নিলাম এই প্ল্যাটফর্মের। নিজেদের কথা বলার মধ্য দিয়েই নতুন স্বপ্নের যাত্রা শুরু হলো।”

আরও পড়ুন

×