ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

কালের যাত্রা ২০২৫

প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি

প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি

আনু মুহাম্মদ

আনু মুহাম্মদ

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৫৯ | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৭:৪৫

২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত অর্থনীতির যে গতি বা ধারা ছিল, সেখানে অচিন্তনীয় মাত্রায় কতিপয় গোষ্ঠীর লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল; যার ফলে দীর্ঘমেয়াদি অনেক ক্ষতির অবস্থা তৈরি হয়। প্রত্যক্ষ ফলাফলে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যেতে থাকে। অতিব্যয়ে করা ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলোর জন্য ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকে। মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় ব্যাপকভাবে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার উঁচু থাকলেও কর্মসংস্থানের সমস্যা কমেনি। অন্যান্য জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বাড়ে। এর সঙ্গে সম্পদ কেন্দ্রীভবন, বৈষম্য বৃদ্ধি এগুলো যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে, তাতে শেখ হাসিনা সরকারের পতন না ঘটলে, এই সংকটগুলো আরও বেশি ঘনীভূত হতো।

সরকার পতনের পরে কতিপয় গোষ্ঠীর ব্যাংক কিংবা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো থেকে দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও সম্পদ পাচারের যে স্রোত চলছিল, সেটা বন্ধ হয়। চাঁদাবাজির ব্যাপক নেটওয়ার্কও থমকে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করেছে। এগুলোর রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের অঙ্গীকার করেছে সরকার। শ্বেতপত্র কমিটি ইতোমধ্যেই তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তাতে হাসিনার আমলের অব্যবস্থা, দুর্নীতি ও লুটপাটের একটা বিশদ চিত্র সন্নিবেশিত হয়েছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের পরবর্তী কর্মসূচি গ্রহণে সহায়ক হবে। 

প্রকৃতপক্ষে হাসিনা সরকারের সময় বাংলাদেশের অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওপরের আদেশেই কাজ হতো, প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া কাজ করত না। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবার ঠিক জায়গামতো নিয়ে আসা এবং জনস্বার্থে পুনর্বিন্যাস করাটা হচ্ছে বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এসব ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখিনি। রিপোর্ট দেওয়ার আগেও সরকার কিছু কাজ করতে পারে। এখন যিনি অর্থ উপদেষ্টা এবং যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, তারা আগেও সরব ছিলেন। তারা খুব ভালো করে জানেন যে ব্যাংকিং খাতে কীভাবে অনিয়ম হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ তদারকিতে কীভাবে কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যাংকিং নীতিমালা তৈরি করেছে এবং পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে; কতিপয় গোষ্ঠীর ঋণের নামে ব্যাংক লুট, অসম্ভব মাত্রায় এস আলম গ্রুপ, বসুন্ধরা, সামিট, বেক্সিমকো ইত্যাদি গ্রুপকে আর্থিক সুবিধা দিতে গিয়ে আর্থিক খাতে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংককে একটা কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো, যেসব ব্যাংক রাজনৈতিক ও কতিপয় গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল সেগুলোকে পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাস বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্ধ করে দেওয়া, মূল্যস্ফীতি ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় মুদ্রানীতি প্রণয়ন– এগুলো করার জন্য কমিশনের সংস্কার কর্মসূচি বা কমিশনের রিপোর্টের অপেক্ষা করার দরকার নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার যদি ঠিকমতো হয়, ব্যাংকিং ক্ষেত্রে অনিয়ম যদি দূর হয়, বাজারে মুদ্রাব্যবস্থা যদি সুস্থ অবস্থায় আসে, ডলার এক্সচেঞ্জ রেট স্বাভাবিক অবস্থায় আসে– এসবই মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এগুলো নিয়ে আগেই সক্রিয় ভূমিকা দরকার ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ে ফরাসউদ্দিনের রিপোর্ট, শেয়ারবাজার নিয়ে ইব্রাহিম খালিদের রিপোর্টকে নির্দেশনা হিসেবে সরকার ব্যবহার করতে পারত। এগুলো নিয়ে সরকারের কোনো ভাষ্য বা কার্যকর উদ্যোগ এখনও দেখতে পাইনি আমরা। ২০২৫ সালের প্রথম দিকেই সরকার এটাতে হাত দিতে পারে। 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে দায়মুক্তি আইন সরকার স্থগিত করলেও এই দায়মুক্তি আইনের অধীনে যেসব প্রাণবিনাশী প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যেসব জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি করা হয়েছে, সেগুলো অব্যাহত রাখা হবে বলে জানানো হয়েছে। আমি মনে করি, এটা খুবই ভুল সিদ্ধান্ত। যেসব প্রকল্প ও চুক্তি বাংলাদেশের জনগণের জন্য বিপজ্জনক, বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ এবং বড় আর্থিক বোঝা তৈরি করতে পারে– এসব প্রকল্প এবং চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন দরকার। যেগুলো খুবই ক্ষতিকর সেগুলো বাতিল করা দরকার। যেমন– আমি উদাহরণ হিসেবে নির্দিষ্ট করে রামপাল ও রূপপুরের কথা বলব।

সুন্দরবনবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র মূলত ভারতের প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা ভারতের হাতে। এই দুটো প্রকল্প নিয়ে প্রচুর পরিমাণে কাগজপত্র, গবেষণা, দলিলপত্র আছে। এগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি এবং ক্ষতিকর দিক জানার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। এগুলো নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে, যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আছে। এগুলো বাতিল করলে কিছু আর্থিক ক্ষতি হবে ঠিকই, কিন্তু বাতিল না করলে আর্থিক ক্ষতি হবে আরও বেশি। সেই সঙ্গে হবে প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের হবে বড় ক্ষতি। সে জন্য এগুলোর বোঝা থেকে কীভাবে বাংলাদেশ ও মানুষকে রক্ষা করা যায়, সেটা নিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া সরকার এখনই শুরু করতে পারে। 

অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে মৌলিক কিছু পার্থক্যের সূচনা করতে হবে সরকারকে। যেমন– শেখ হাসিনা সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সামরিক-বেসামরিক আমলা ও পুলিশকে যথেষ্ট সুবিধা দিয়েছে। এবং কতিপয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে খুলে দেওয়া হয়েছে ব্যাংক ও অনান্য আর্থিক খাত। বিপরীতে যারা বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য ও চাপের সম্মুখীন হয়েছে, তার মধ্যে প্রধানত হচ্ছে সর্বজনের জন্য প্রয়োজনীয় খাতগুলো। যেমন– শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, নিয়োগ, অবহেলার কারণে এখানে একটি নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। এর পাশাপাশি শ্রমিকদের কথাও আমরা বলতে পারি। শিক্ষার্থী ও শ্রমিক– এই দুই জনগোষ্ঠী আর্থিকভাবেও বড় ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়েছে। 

এই অবস্থার পরিবর্তন করতে গেলে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বরাদ্দের যে ধারাবাহিকতা আমরা হাসিনার আমলে দেখেছি, সেটা পরিবর্তন করতে হবে, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতের বরাদ্দ আন্তজার্তিক মানে নিয়ে আসতে হবে। এবং এই দুটো খাতে বড় ধরনের পুনর্বিন্যাস দরকার আছে। এগুলো নিয়ে সরকার এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। কিন্তু সূচনা হিসেবে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও এর প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। 

এর পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য জাতীয় নূন্যতম মজুরি, এটা সরকার ঘোষণা করতে পারে ২০২৫ সালের প্রথম দিকেই। এর মূলনীতি হতে হবে, কোনোভাবেই ন্যূনতম মজুরি দারিদ্র্যসীমার আয়ের নিচে হবে না, দারিদ্র্যসীমার আয়ের ওপরে হতে হবে। এই নীতিমালাই হবে জাতীয় ন্যূনতম মজুরির ভিত্তি।  

দেশের প্রায় সর্বস্তরে আগের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে কিন্তু নতুন করে আবার চাঁদাবাজি দেখতে পাচ্ছি। তারপর পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে চার-পাঁচটা গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশের বাজারের বেশ কিছু পণ্য সরবরাহ। এই যে কতিপয় গোষ্ঠীর বাজার নিয়ন্ত্রণ, এটা আগের সরকার ভাঙার বদলে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। বর্তমান সরকারও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এই চাঁদাবাজি নতুন করে শুরু হওয়া কিংবা অলিগোপলির নিয়ন্ত্রণ অর্থনীতির ওপরে, এটাকে ভাঙা বর্তমান সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। 

স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকারি পণ্য বিপণন ব্যবস্থার একটা সামগ্রিক পুনর্বিন্যাসের মধ্য দিয়ে রেশনিং ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে। কতিপয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থেকে যেন বাজার মুক্ত হতে পারে এবং একটা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা তৈরি হয়। রেশনিং ব্যবস্থায় যদি জিনিসপত্রের সরবরাহ যথাযথভাবে হয় তাহলে বাজারের ওপর কতিপয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ কাজ করতে পারবে না। বাংলাদেশে শুধু সামরিক বাহিনী, পুলিশসহ কিছু বাহিনীর ক্ষেত্রে রেশনিং ব্যবস্থা আছে। সকল মানুষের জন্য রেশনিং ব্যবস্থার সূচনা জায়গা তৈরি করতে পারে এই সরকার। এটা সম্ভবের উদাহরণ বহু দেশে আছে। এর জন্য যে খুব বেশি সময় দিতে হবে বা অনেক বেশি গবেষণা করতে হবে তা নয়। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এটাকে পুনর্বিন্যাস করা যায়।

আগেই বলেছি শেখ হাসিনার আমলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সব ক্ষেত্রের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যাংকিং খাত, অবকাঠামো পরিচালনা, বিভিন্ন প্রকল্প নির্ধারণ, সকল খাতে ওপরের আদেশে সব কাজ হতো। আদালত পর্যন্ত। সেই প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াকে আবার পুনরুদ্ধার করার জন্য সরকারের বিশেষ মনোযোগ দরকার; যেটা এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। উল্টো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জোরজবরদস্তি বা মব তৎপরতা দেখতে পাচ্ছি। দল পাকিয়ে পদ দখল, জোরজবরদস্তি বা ট্যাগ করে পদত্যাগ করানো ইত্যাদি কোনো প্রতিষ্ঠানেই স্বস্তি দিচ্ছে না।  যেগুলো পরিবর্তন বা বন্ধ না হলে প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া দাঁড়াতে পারবে না আর প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া না দাঁড়াতে পারলে যোগ্য লোকজন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা বিভিন্ন সরকার দেখেছি, তাদের বাগাড়ম্বর শুনেছি কিন্তু এর নীতিগত যে কাঠামো, তা তৈরির ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি। বাংলাদেশের পানি, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে, পাট, শিক্ষা, চিকিৎসা ও অবকাঠামোর ক্ষেত্রে তাদের ঋণ আছে অনেক এবং তাদের বিভিন্ন ধরনের নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা আছে। সেই নীতিমালার ধারাতেই ব্যাপক দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল।

এদের সমর্থিত যেসব প্রকল্প আছে, সেই প্রকল্পগুলোর বিস্তারিত অনুসন্ধান হতে হবে। সেই অনুসন্ধানে যদি দেখা যায়, এসব প্রকল্পের কারণে অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক বোঝা তৈরি হয়েছে কিংবা জনগণের প্রয়োজনের বিপরীতে কতিপয় গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়েছে, তাহলে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবিকেও জবাবদিহির আওতায় আনার একটা প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এটা না করলে অর্থনীতির ধারার কোনো পরিবর্তন হবে না। 

লেখক: শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং সদস্য, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি

 

আরও পড়ুন

×