এটাই মেসির গুরুবিদ্যা

সঞ্জয় সাহা পিয়াল
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫ | ০৮:২৫
তুলনা আর তর্কের বাইরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন লুসাইলে সেই রাতে বিশ্বকাপ স্পর্শ করে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে তাঁর যে অদৃশ্য লড়াই ছিল, কয়েক বছর হলো সেটাও আগ্রহ হারিয়েছে ফুটবল বাজারে। ইউরোপের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফুটবলের রক্তচাপ কমাতে একরকম নিরিবিলিতেই আছেন মায়ামিতে। তার পরও পায়ে যখন বুট চড়ে, গায়ে দলের জার্সি, তখন সাঁইত্রিশের শরীরেও সতেরোর বিদ্যুৎ ছুটে যায়। ফুটবলের মাঝে পারিজাতের গন্ধ খুঁজে পান লিওনেল মেসি।
ক্লাব বিশ্বকাপে মায়ামির হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে এমন মায়াবী মেসিকেই খুঁজে পেল ফুটবল বিশ্ব। বাঁ পায়ে তাঁর নেওয়া ফ্রিকিক থেকেই ক্ষয়ে যাওয়া প্রেম জাগ্রত হলো ভক্তকুলের। পর্তুগালের ক্লাব এফসি পোর্তোর বিপক্ষে মেসির বাঁকানো ধনুকই যেন ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের দাম্ভিকতায় আঘাত হানল। কেননা ইউরোপের কোনো ক্লাবকে যে ফিফার আসরে আমেরিকার কোনো দল হারাতে পারে, সেটি কল্পনাতেই ছিল না কারও। কিন্তু যে দলে মেসির মতো ‘ফ্রিকিক কিং’ রয়েছে, সেখানে জাদুকরী কিছু যে ঘটবে না, সে দাবি জোর গলায় কেউই বলে দিতে পারে না। ফ্রিকিকের এই শিল্প যে তাঁর ‘গুরুবিদ্যা’। এক সময় দিয়েগো ম্যারাডোনার গুরুকুল থেকেই তা আত্মস্থ করেছিলেন। সহজে কি আর তা ভোলা যায়?
নিজের সময়ে স্পট কিকে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। ৬২টি গোল করেছিলেন তিনি শুধু ফ্রিকিকে ডিফেন্সের দেয়াল ভেঙে। ফুটবল ইতিহাসে আর্জেন্টিনার এ কিংবদন্তি এখনও ফ্রিকিক থেকে গোল স্কোরারদের বৈশ্বিক তালিকায় আট নম্বরে। সেখানে তাঁর শিষ্য মেসি আছেন তিন নম্বরে ৬৮টি গোল করে। তালিকার শীর্ষে আছেন ব্রাজিলের জুনিনহো। ৭৭টি গোল করেছেন ফ্রিকিক থেকে। তবে বছর পঞ্চাশের সাবেক এ মিডফিল্ডার তাঁর ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময়ই খেলেছেন স্বদেশি ক্লাব ভাস্কো দ্য গামার হয়ে। সে কারণে এ অঞ্চলের অনেকেই টেলিভিশনে তাঁর ‘কুনুকলেবল’ কৌশলের গোলগুলো উপভোগ করতে পারেনি টেলিভিশনে। সেদিক থেকে পেলের কিছু বিস্ময়কর ফ্রিকিক ইউটিউবে সার্চ দিয়ে দেখা যায়। একটি প্রজন্মের কাছে পেলেই ছিলেন ফুটবলের এ আকর্ষণীয় গোলের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার। ৭০টি গোল করে এই তালিকায় মেসির ঠিক ওপরেই তিনি।
ফুটবলে ফ্রিকিক থেকে গোল করা অন্যতম কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটি। গোলপোস্ট থেকে কিক নেওয়ার দূরত্ব, নির্ভুলতা, ডিফেন্ডার এবং গোলরক্ষকের সমন্বয়ে দেয়াল দিয়ে দৃশ্যমানতা আটকানোর চেষ্টা– এসব ভেদ করে তারাই গোলে রংধনু সৃষ্টি করতে পারে, যাদের মধ্যে অনন্য প্রতিভা রয়েছে। তবে এর সঙ্গে চেষ্টা এবং অনুশীলনেরও দরকার আছে। ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে দূরত্ব আর বাতাসের বেগের সঙ্গে অঙ্ক কষার মতো নিষ্ঠা আছে। ঠিক এমন কথাই এক বিকালে মেসিকে কাছে ডেকে বলেছিলেন ম্যারাডোনা।
ঘটনাটা বছর ১৬ আগের। সে সময় আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের প্রধান কোচ ম্যারাডোনা মার্শেইয়ে ক্যাম্প বসিয়েছেন। এক দিন পর স্থানীয় একটি দলের সঙ্গে ম্যাচ। সেখানে অনুশীলনে মাশ্চেরানো, তেভেজ আর মেসি শট প্র্যাকটিস করছিলেন। বারবার মেসির ভুল হচ্ছিল। গোলকিপার হয় বল ঠেকিয়ে দিচ্ছিল, না হয় পোস্টের ওপর দিয়ে তা বেরিয়ে যাচ্ছিল। বিরক্ত মেসি সেখান থেকে বেরিয়ে লকাররুমে দিকে শাওয়ার নিতে যাচ্ছিলেন। সে সময় আর্জেন্টিনা দলের ফিটনেস কোচ ফার্নান্দো সিগনোরনি তাঁর একটি বইয়ে ঘটনাটির বর্ণনা দেন এভাবে। তখন ম্যারাডোনা এসে কাঁধে হাত রাখেন মেসির। বলতে থাকেন, ‘শট নিতে এত তাড়াহুড়া করো না। একটু সময় নাও। তোমার দৌড়ানোর গতি কমিয়ে দাও, তা নাহলে বলও জানবে না যে তুমি কী চাও।’
আর্জেন্টিনার সেই ফিটনেস কোচ লেখেন, ‘তারপর থেকে প্রতিদিন অনুশীলনের পর মেসি ফ্রিকিক নিয়ে বাড়তি সময় দিতে থাকে। সেটা সে যেমন বার্সেলোনাতেও করে, তেমনি আর্জেন্টিনা দলের অনুশীলনেও করে। এভাবে ফ্রিকিকে নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নেয় মেসি।’
এরপর বার্সাতে পেনাল্টি কিকের চেয়েও ফ্রিকিক থেকে বেশি গোল পান মেসি। ৫০টি গোল করেছিলেন তিনি বার্সায় থাকতে, পিএসজিতে এসে দুটি, মায়ামিতে এসে পাঁচটি। আর্জেন্টিনার জার্সিতে করেছেন ১১টি। এভাবেই মেসির প্রতিটি ফ্রিকিকের সঙ্গেই যেন জড়িয়ে থাকে ম্যারাডোনার প্রতি তাঁর ‘গুরুদক্ষিণা’।