গোলাপীদের শিক্ষার গল্পটা এমনই

এক বাঁশের সাঁকো। কচি পায়ে পাড় হতে গিয়ে পড়ে গেল নদীতে। দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র রেহান সাঁতরে উঠলেও পানিতে ভিজে টইটুম্বুর তার বই। বুধবার সকালে সিংড়া উপজেলার আনন্দনগর-কৃষ্ণনগর গ্রামের মরা আত্রাই নদীতে - সমকাল
নবীউর রহমান পিপলু, নাটোর
প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২২ | ০০:২১
সকাল ৯টায় ক্লাস। এ ঘর থেকে ও ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মনি, রিয়া, আমেনা, রেহান, গোলাপী, আহাদ আলীরা। কেউ ক্লাস দ্বিতীয়, কেউ তৃতীয়, কেউবা চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণির। বেশিরভাগের পরনে ইউনিফর্ম। বাকিরা রঙিন পোশাকে। পিঠে বইভর্তি ব্যাগ। বাড়ির পাশেই নদী। সেই নদীর ওপারে স্কুল। এক বাঁশওয়ালা সাঁকোই একমাত্র ভরসা।
ছোট্ট সোনামণিরা লাইন ধরে সাঁকো পাড়ি দিতে শুরু করল। মনি, রিয়া, আমেনাসহ অন্যরা কোনোমতে ওপারে পৌঁছাল। কিন্তু গোলাপী ও রেহান পারল না। মাঝ সাঁকোতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে নিচে পড়ে গেল। কোমল দেহখানির সঙ্গে ভিজে একাকার তাদের বইপত্র।
গ্রামের সন্তান। সাঁতার জানা ছিল। তাই দুর্ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু টইটম্বুর শরীর নিয়ে বাড়িতে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে রেহান ও গোলাপীর শিক্ষাজীবন থেকে একটি মহামূল্যবান দিন যেন ঝরে পড়ল।
এ ঘটনা গতকাল বুধবার সকালের। নাটোরের সিংড়া উপজেলার আনন্দনগর-কৃষ্ণনগর গ্রামের। এই গ্রাম আলাদা করেছে মরা আত্রাই নদী। নদীর এপারে কৃষ্ণনগর গ্রাম। ওপারে আনন্দনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির মোট শিক্ষার্থী ৩৫০ জন। প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর বাড়ি নদীর অপর পারে।
তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী গোলাপী। বাবা নেই। দাদি শান্তি বেগম বলছিলেন, পানিতে নাতনির বাংলা বই একদম নষ্ট হয়ে গেছে। অন্য বইগুলো রোদে শুকাতে দিয়েছেন। ঘটনা শুনে স্কুল থেকে পুরোনো বই দিয়েছেন শিক্ষক।
রেহান পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। বাবা মোহম্মদ আলী। পেশায় কৃষক এই অভিভাবক বলেন, 'ছেলেকে স্কুলে দিয়েছি লেখাপড়া শিখে বড় হবে, চাকরি করবে। আমাদের দুঃখ ঘুচবে। কিন্তু উল্টো এখন আতংকে দিন কাটে।' নদীতে পড়ে ছেলের যেসব বই নষ্ট হয়েছে, সেগুলো শিক্ষকরা পুরোনো হলেও আবার দেবেন বলে তাকে আশ্বস্ত করেছেন।
স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ওমর ফারুক। তার ভাষ্য, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁশের সাঁকো পার হতে গিয়ে প্রতিদিনই দু-একজন পানিতে পড়ে যায়। যেসব শিশু সাঁতার জানে না, তাদের বাবা-মা বা অন্য কেউ সাঁকো পার করে দেন। কেউ কেউ তো সন্তানদের স্কুলেই পাঠাতে চান না।
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আনন্দনগর ও কৃষ্ণনগর গ্রামে প্রায় আট হাজার মানুষের বসবাস। একটি সেতুর অভাবে তাদের ভাগ্যের বদল ঘটছে না। শত কষ্ট ও ঝুঁকি সত্ত্বেও থেমে নেই তাদের জীবনসংগ্রাম। বিশেষ করে শত শত শিক্ষার্থী যেভাবে পড়াশোনা করছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর।
গ্রামবাসী জানিয়েছেন, আগে এখানে সাঁকোও ছিল না। তখন পাতিলের মধ্যে বইখাতা ও কাপড় ভরে সাঁতার কেটে নদী পার হতো শিক্ষার্থীরা। নদীর ওপারে গিয়ে তারা পোশাক পরে স্কুলে যেত। এই দুর্দশা দেখে ইউপি চেয়ারম্যান গত ১৭ মার্চ বাঁশের সাঁকো করে দেন।
স্থানীয়রা জানান, আনন্দনগর ও কৃষ্ণনগর নদীর বাঁধে প্রায় এক হাজার পরিবারের বসবাস। এখানকার অধিকাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর। কিন্তু তাদের স্বপ্ন আকাশ সমান। সন্তানরা পড়াশোনা করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বড় কর্মকর্তা হবে, এটাই তাদের চাওয়া।
নদী পারাপারে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের পাশাপাশি অসুস্থ ব্যক্তিদের হাসপাতালে আনা-নেওয়া এবং মৃত ব্যক্তিদের দাফন-সৎকারেও দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
১৯৭৪ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৩৫০ জন। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষার্থী আয়নুল হক। ৮১ বছরের এই প্রবীণ ব্যক্তিত্ব বলেন, তাদের সময়ে মরা আত্রাই পারাপারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, যারা সাঁতার জানতেন তারাই সাঁতরে নদী পার হয়ে স্কুলে যেতেন। সেই সময়ে বেশি বয়সেই স্কুলে ভর্তি হতেন সবাই। এ কারণে অনেকে ঝরেও পড়েছেন।
রাজশাহী ওয়াসার উপসহকারী প্রকৌশলী আব্দুর রহিম। তিনি আনন্দনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। গতকাল রাতে তিনি বলছিলেন, তিনিসহ নদীপাড়ের সবাই সাঁতরে নদী পার হয়ে ক্লাসে হাজির হয়েছেন। সেই স্মৃতি এখনও মনে পড়ে। মরা আত্রাই, যেটিকে চলনবিলের খাল বলা হয়, সেই খালের ওপর একটি সেতু একান্তভাবে প্রয়োজন। সেতু না হওয়ায় নদীর ওপারের অনেকেই ঝরে পড়েছে। তবে এখন বিজ্ঞানের যুগে এবং উন্নয়নের বাংলাদেশে মরা আত্রাই নদীর আনন্দনগর এলাকায় একটি সেতু নির্মিত হলে আর কেউ ঝরে পড়বে না।
আনন্দনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক মো. লোকমান হাকিম বলেন, দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী এই সাঁকো পার হয়ে স্কুলে আসে। সাঁতার না জানা শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। এতে করে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার শংকাও থেকে যায়।
ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান স্বপন বলেন, সাঁতার কেটে নদী পাড়ি দিয়ে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাতায়াত করে জানার পর তিনি নিজ উদ্যোগে একটি বাঁশের আড় বা সাঁকো তৈরি করে দিয়েছেন। আর সেখানে সেতু নির্মাণের জন্য সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন।
বিষয়টি জানার পর সমস্যা সমাধানে আলাপ-আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আলী আশরাফ।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, সিংড়ার দক্ষিণাঞ্চলের শেষ সীমানা ও দুর্গম আনন্দনগর ও কৃষ্ণনগর গ্রাম। এলাকার জনগুরুত্বপূর্ণ চামারি এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মূল আত্রাই নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। আনন্দনগর-কৃষ্ণনগর গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া আত্রাই নদীর শাখা মরা আত্রাই বর্ষা মৌসুমে খরস্রোতা রূপ ধারণ করে। তখন বাঁশের কোনো সাঁকো কাজে আসে না। এলাকার মানুষের কথা ভেবে বিশেষ করে শিশুদের শিক্ষাজীবন যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য সাঁকোটি এই শুস্ক মৌসুমে মোটা করে বাঁশের চাটাইয়ের তৈরি শক্ত একটি সাঁকো দ্রুততম সময়ের মধ্যে করে দেওয়া হবে। তখন এটি দিয়ে বর্ষা মৌসুম পর্যন্ত সবাই নিশ্চিন্তে পারাপার হতে পারবেন।
আনন্দনগর গ্রামের কৃষক আব্দুল জলিল, আল আমিন, শান্তি বেগম ও রজিনা বেগম বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁশের আড় পারাপারে তাদের সন্তানরা নদীতে পড়ে যায়। শুধু এখানকার মানুষের ভাগ্য বদলে দিতে নয়, ঝুঁকিমুক্ত জীবনের জন্যও এই নদীতে একটি সেতুর দাবি তাদের।
- বিষয় :
- বাঁশের সাঁকো
- সিংড়া
- স্কুল