ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

চার বছরে অর্ধকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

১৮ কোটি টাকার যন্ত্র সাত বছর বাক্সবন্দি

ফরিদপুর মেডিকেলে ৫৫ কোটি টাকার যন্ত্র বিকল

১৮ কোটি টাকার যন্ত্র সাত বছর বাক্সবন্দি

ছবি: সমকাল

 তবিবুর রহমান, ফরিদপুর থেকে ফিরে 

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ | ০১:২০ | আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ | ০৯:৩৫

ফরিদপুরের ৩৫ বছর বয়সী জামিলা বেগম বুকে ব্যথা নিয়ে শহরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। রোগ শনাক্তে গত এক সপ্তাহে তাঁকে চারটি পরীক্ষা দেন চিকিৎসক। হাসপাতালের যন্ত্র অচল থাকায় তিনটি পরীক্ষাই করাতে হয় বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। পরীক্ষায় হৃৎপিণ্ডে ব্লক ধরা পড়ে তাঁর। 

রিং পরাতে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। জামিলার স্বামী জামাল উদ্দিন বলেন, ‘তিন দিন ধরে তাঁর (জামিলা) বাঁ হাত কাজ করছে না। ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করানোর মতো টাকা নেই। কী করব– ভেবে পাচ্ছি না।’

একই পরিস্থিতি হৃদরোগে আক্রান্ত ৭০ বছর বয়সী আবুল রউফের। চার দিন ধরে তিনি হাসপাতালে ভর্তি। পরীক্ষায় তাঁর হৃৎপিণ্ডেও ব্লক ধরা পড়ে। তবে কয়টা ও কত শতাংশ ব্লক, তা জানতে এনজিওগ্রাম করা জরুরি। রউফের স্ত্রী মুনজুরা খাতুন বলেন, এখানে হৃদরোগীর চিকিৎসা নেই। টাকার অভাবে বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পারিনি। সরকারি হাসপাতালে এনজিওগ্রাম করার ব্যবস্থা থাকলে এমন অসহায় পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

গত মঙ্গলবার দুপুরে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিনতলায় হৃদরোগ বিভাগে ঢুকতেই চোখে পড়ে, বারান্দায় বিছানা পেতে রোগীর চিকিৎসা চলছে। ওয়ার্ডে শয্যা না পেয়ে অনেকেই নিচে বিছানা পেতে শুয়ে আছেন। তিনতলায় সাতটি কক্ষ নিয়ে ক্যাথল্যাব ইউনিট গঠন করা হয়েছে। এ ইউনিটে ক্যাথল্যাব মেশিন প্রতিস্থাপন করা হয় ২০১৭ সালে। তবে জনবল সংকটে এক দিনও এ যন্ত্র ব্যবহার করা যায়নি। কক্ষগুলো সাত বছর ধরে তালাবদ্ধ। নেই জেনারেটর বা বিদ্যুৎ সংযোগ। ক্যাথল্যাব যন্ত্র সংরক্ষণে একজন নার্সকে দায়িত্ব দেওয়া আছে। ওই নার্সের মাধ্যমে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, ৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা দিয়ে ক্যাথল্যাব যন্ত্র স্থাপন করা হলেও ব্যবহার না হওয়ায় এখনও নতুনের মতো রয়েছে।

হৃদরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. কামাল উদ্দিন বলেন, দৈনিক ৭০ থেকে ৮০ রোগীর এনজিওগ্রাম প্রয়োজন। জনবল সংকটে ক্যাথল্যাব চালু করা সম্ভব হয়নি। এ যন্ত্র পরিচালনায় দক্ষ টেকনিশিয়ান প্রয়োজন হয়। আমাদের হাসপাতালে সেই জনবল নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু এনজিওগ্রাম করতে না পারায় হৃদরোগ বিভাগে দৈনিক গড়ে চার থেকে পাঁচজনের মৃত্যু হয়।

শুধু ক্যাথল্যাব নয়, এই হাসপাতালে মৌলিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ৫৫ কোটি টাকার যন্ত্র অকেজো হয়ে আছে। এসব যন্ত্রপাতির মধ্যে ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত রেডিওথেরাপি যন্ত্র সাত বছর ধরে বাক্সবন্দি। ২০১৭ সালে এ মেশিন কেনা হয়েছিল ১৮ কোটি ৪০ লাখ টাকায়। ওই সময় রোগ শনাক্তে আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্র এমআরআই কেনা হয়। নিম্নমানের যন্ত্র হওয়ায় কয়েক দিন পরপর এই যন্ত্র অকেজো হয়ে যায়। তিন মাস ধরে হিলিয়াম গ্যাস কিনতে না পারায় পড়ে আছে এই যন্ত্রও। যন্ত্রটি কেনা হয় ২৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকায়। এ ছাড়া ছয় মাস ধরে বিকল ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন। ৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা খরচ করে ২০১৭ সালে যন্ত্রটি কেনা হয়।

গত বছর বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের কার্যালয় ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে এসব যন্ত্রপাতি কেনাকাটার নামে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নানা অনিয়মের মাধ্যমে ৪৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, কেনাকাটায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল (পিপিআর) মানা হয়নি। লঙ্ঘন করা হয়েছে আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ বিধি। দরপত্র  ছাড়াই কেনাকাটা ও বিল পরিশোধ করা হয়েছে। দরপত্রের চুক্তি অনুসারে মালপত্র বুঝে না পেয়েও বিল দেওয়া হয়েছে।

২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর ক্রয় পরিকল্পনা ছাড়াই এমএসআর সামগ্রী কিনতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ জন্য গঠন করা হয় হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে সভাপতি করে সাত সদস্যের মূল্যায়ন কমিটি। একই ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে চুক্তি ও কার্যাদেশ ইস্যু করে। তবে পিপিআর ২০০৮-এ বিধি ৩৬(২) অনুসারে একই ব্যক্তি মূল্যায়ন কমিটির চেয়ারম্যান এবং অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ হতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিউ) ইস্যুর নির্ধারিত ফরমে চুক্তি না করে স্ট্যাম্পে টাকার পরিমাণ এবং তারিখ ছাড়াই সই করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় মূল্যায়িত দরপত্রে অনুমোদন ছাড়াই ৭ কোটি ৫৩ লাখ ২৭ হাজার ১২৮ টাকার কেনাকাটা করা হয়। একইভাবে বাজারদর থেকে বেশি দামে এমএসআর সরঞ্জাম কেনায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৮৫ হাজার ৬৬৮ টাকা।

ফরিদপুরের এই হাসপাতালে রোগ শনাক্তের মৌলিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার অধিকাংশ যন্ত্র নষ্ট থাকায় রোগীদের সব পরীক্ষা করতে হয় বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। দীর্ঘদিন ধরে এসব যন্ত্রপাতি বিকল থাকায় হাসপাতালে দালালের দৌরাত্ম্য বেড়েছে; একশ্রেণির চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর যোগসাজশে হাসপাতালের আশপাশে গড়ে উঠেছে ২০টির বেশি বেসরকারি ক্লিনিক। একদিকে হাসপাতালে যেমন প্রচুর রোগীর চাপ, অন্যদিকে চিকিৎসা নিতে আসা গ্রামের মানুষকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিতে চলে দালালের নানা তৎপরতা। এতে চরম অব্যবস্থাপনায় সুনাম হারাচ্ছে হাসপাতালটি।

জানা গেছে, স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত-সমালোচিত ঠিকাদার জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সী সাজ্জাদ হোসাইনের প্রতিষ্ঠান মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজ এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। নানা অনিয়মের কারণে ২০১২ সালে কালো তালিকাভুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। তবু ২০১৭ সালে এ হাসপাতালে ৭৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার কাজ ওই প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়। এর মধ্যে আহমেদ এন্টারপ্রাইজের সরবরাহ করা ৬৫ কোটি টাকার যন্ত্রই অচল। এ ব্যাপারে মুন্সী সাজ্জাদ হোসাইন সমকালকে বলেন, ‘আমরা দরপত্রে যে শর্ত ছিল, তা মেনে এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছি। একটি যন্ত্রপাতিও নিম্নমানের ছিল না।’

এ সময়ে একে একে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ডা. মো. ওমর ফারুক ও ডা. গনপতি বিশ্বাস। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ডা. মো. ওমর ফারুক অবসরে গেছেন বেশ আগেই এবং গনপতি বিশ্বাসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. দীপক কুমার বিশ্বাস বলেন, রেডিওথেরাপি মেশিন প্রতিস্থাপনে অবকাঠামো তথা বাঙ্কার না থাকায় নতুন ভবনের নিচতলায় বাক্সবন্দি করে রাখা হয়। ২০১৭ সালে গণপূর্ত বিভাগ বাঙ্কার প্রতিস্থাপনের কাজ শুরু করলেও পরে অসম্পূর্ণ রেখে চলে যায়। তাই মেশিনটি স্থাপন করা যায়নি। তিনি বলেন, এমআরআই মেশিন চালাতে কিছুদিন পরপর হিলিয়াম গ্যাসের প্রয়োজন হয়। বাজেট সংকটে গ্যাস কিনতে না পারায় এমআরআই পরীক্ষা তিন মাস বন্ধ। দালালের দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করে উপপরিচালক বলেন, হাসপাতালে জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ থাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যন্ত্র প্রতিস্থাপন ও জনবল নিয়োগে একাধিকবার চিঠি দিয়েও সাড়া মেলেনি।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, রোগী বড় হাসপাতালে যায় সেবা পাওয়ার আশায়। মৌলিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্র কেন বাক্সবন্দি রয়েছে, এটি আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব। জনবলের অভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ থাকবে– এটি হতে পারে না।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, সাত বছর ধরে এত টাকার যন্ত্র বাক্সবন্দি, এটি আমার জানা ছিল না। বিষয়টি তদন্ত করে দেখব। যন্ত্রগুলো যদি এখনও ভালো থাকে, তাহলে দ্রুত প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×