ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

জয়-পরাজয়ের সঙ্গে জড়িয়েছে হাসনাতের প্রভাবের হিসাব-নিকাশ

গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাচন

জয়-পরাজয়ের সঙ্গে জড়িয়েছে হাসনাতের প্রভাবের হিসাব-নিকাশ

আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ (ফাইল ফটো)

সুমন চৌধুরী, বরিশাল 

প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২৪ | ১২:৪৮

বরিশালের গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় দীর্ঘ দিন ধরে ইউনিয়ন ও উপজেলা চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আসছেন। ২০০৯ সালের পর থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দলের কার্যক্রম অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ। স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর মুখের কথাই এখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এমন ‘রাজনীতি নিষিদ্ধ’ এলাকায়  রোববার উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে। দুই উপজেলাতেই ভোটারদের মাঝে আছে সহিংসতার আশঙ্কা। ভয়ের পরিবেশেই হবে ভোট।

দুই উপজেলায় হাসানাত সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দুইজন প্রার্থী শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রচার-প্রচারণার সময় আলোচিত অনেক ঘটনা উত্তাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। জয়-পরাজয়ের সঙ্গে জড়িয়েছে জেলায় আওয়ামী লীগের আগামীর নেতৃত্বের হিসাব-নিকাশ। ফলে সবার দৃষ্টি এখন গৌরনদী-আগৈলঝাড়ার দিকে। তবে দুই উপজেলাতেই হাসানাতের বিরুদ্ধে কোনো প্রার্থীর প্রকাশ্যে অভিযোগ নেই।

জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি হাসানাত আবদুল্লাহর বাড়ি আগৈলঝাড়ার সেরাল গ্রামে। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে। চার দশকের বেশি সময় ধরে জেলায় একক আধিপত্য তাঁর। বড় ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ মহানগরের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র। 

তৃতীয় ধাপে দুই উপজেলায় ভোট হওয়ার কথা ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে তা স্থগিত হয়। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, গত রমজানে ছোট ছেলে আশিক আবদুল্লাহ আগৈলঝাড়ার চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে গণসংযোগ শুরু করলে আগ্রহী অন্য প্রার্থীরা চুপসে যান। এদিকে হাসানাতের প্রধান আস্থাভাজন উপজেলা আওযামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র হারিছুর রহমান হারিছ প্রার্থিতা ঘোষণা দেন গৌরনদীতে। গুঞ্জন ছড়ায়, হারিছকে উপজেলা চেয়ারম্যান করে উপনির্বাচনে হাসানাতের মেজো ছেলে মঈন আবদুল্লাহ হবেন পৌর মেয়র। এসবের নেপথ্যে সর্বত্র আলোচিত হয় হাসানাতের নাম। 

এ নিয়ে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হওয়ায় দুই উপজেলাতেই হাসানাতপন্থিদের সহজ হিসাব জটিল হয়ে যায়। অজ্ঞাত কারণে আগৈলঝাড়ায় আশিককে বিরত রেখে হাসানাতের জ্ঞাতি ভাই বর্তমান চেয়ারম্যান রইচ সেরনিয়াবাত হন প্রার্থী। তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন দুইবারের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও শিক্ষক যতীন্দ্র নাথ মিস্ত্রী। ২০১৪ সালে হাসানাতের মতের বাইরে প্রার্থী হয়ে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বহিষ্কার হন। 

গৌরনদীতে হারিছের বিরুদ্ধে তাঁর বড় ভাই বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান, বর্তমান চেয়ারম্যান মনিরুন নাহার মেরী, পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি মনির হোসেন মিয়া ও যুগ্ম সম্পাদক মাহিলাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু একাট্টা হয়ে মাঠে নামেন। তাদের একক প্রার্থী মনির হোসেন মিয়া। গত ১ মে রাতে সৈকত গুহ পিকলুকে কুপিয়ে জখম করার মধ্য দিয়ে এখানে উত্তাপের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। 

চাপের মুখে হারিছ 
২০১২ সালে পৌর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে হারিছ গৌরনদীতে অপ্রতিরোধ্য। সবার ধারণা, তাঁর মাধ্যমে হাসানাতের আদেশ-নির্দেশ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, ত্যাগী ও সিনিয়র নেতাদের মারধর এবং অপদস্থ করে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করা। উপজেলায় হারিছ প্রার্থী হয়ে গত ১ যুগের মধ্যে সবচেয়ে চাপের মুখে পড়েন। শুরু থেকে হারিছবিরোধীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁর ভাই হাবিবুর রহমান। নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে যুক্ত হয়েছেন আরেক ভাই ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এনায়েত করীম।

স্বস্তিতে নেই রইচ
আগৈলঝাড়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রইচের বিরুদ্ধে হারিছের মতো অভিযোগ নেই। তবে এখানে ভোট ও রাজনীতি নিষিদ্ধ অবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধদের ভোটে জয়ের আশা দেখছেন প্রতিদ্বন্দ্বী যতীন্দ্র নাথ মিস্ত্রী। উপজেলার জনসংখ্যার ৬০ ভাগের বেশি সংখ্যালঘু। যতীন্দ্র নাথ সমকালকে বলেন, ‘গৌরনদী-আগৈলঝাড়ার মানুষ নিজ দেশে পরাধীন। রইচের কর্মীরা হুমকি দিচ্ছে, কেন্দ্রে গেলে দেখিয়ে ভোট দিতে হবে। সকাল ১০টার মধ্যে ভোট শেষ করা হবে। তারা এমপির (হাসানাত) লোক। এমপির নির্দেশমতো ভোট হবে।’ প্রতিটি কেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিতে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করেছেন তিনি। 

জেলায় আধিপত্যের লড়াই
গত বছর সিটি ও এ বছর সংসদ নির্বাচনে হাসানাত-পুত্র সাদিক দলের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে মহানগরে একক আধিপত্য হারিয়েছেন। হাসানাতের ছোট ভাই মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ও মহানগর-সদরের এমপি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের নেতৃত্বে নতুন শক্তির উত্থান ঘটেছে। তারা স্থানীয় রাজনীতিতে হাসানাত পরিবারবিরোধী হিসেবে পরিচিত। এদিকে সদর-মহানগরের দলীয় এমপি জাহিদ ফারুক ও বাকেরগঞ্জের হাফিজ মল্লিক এবং মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলার স্বতন্ত্র এমপি পঙ্কজ নাথ কখনও হাসানাত বলয়ে ছিলেন না। চলমান উপজেলা নির্বাচনে সদর, বাবুগঞ্জ ও মুলাদীতে হাসানাত সমর্থিত প্রার্থীরা হেরেছেন। নিজ সংসদীয় আসনভুক্ত গৌরনদী-আগৈলঝাড়ায় অনুসারীরা হারলে বরিশালের রাজনীতিতে হাসানাতের নেতৃত্বের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ধারণা সচেতন মহলের।
 

আরও পড়ুন

×