হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার হদিস নেই, হিসাবে গরমিল

ফাইল ছবি
সনি আজাদ, চারঘাট
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৪ | ২২:৩০
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়েছে। এর পর বেশির ভাগ পৌরসভা স্বাভাবিক নাগরিকসেবা দেওয়া শুরু করেছে। তবে এর ব্যতিক্রম রাজশাহীর চারঘাট। হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এম এস আসাদ উজ জামান বাচ্চুর স্বেচ্ছাচারিতা ও নানা অনিয়মে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি দু’মাস অনুপস্থিত থাকলেও তাঁকে শোকজ পর্যন্ত করেনি কর্তৃপক্ষ। কয়েক লাখ টাকার হিসাবেও গরমিল পেয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কর্মকর্তা-কর্মচারীর অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পৌরসভার ‘অলিখিত বাদশাহ’ ছিলেন হিসাবরক্ষক বাচ্চু। তিনি স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ায় যে কর্মকর্তাই তাঁকে জবাবদিহির আওতায় আনতে চেয়েছেন, তাঁকেই নেতাকর্মীর মাধ্যমে চাপ দিয়ে পৌরসভাছাড়া করেছেন। পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা (সচিব) রবিউল ইসলামও চলে যেতে বাধ্য হন। পদটি এখনও ফাঁকা। নিজেকে মেয়রের আস্থাভাজন দাবি করে সব নিয়ন্ত্রণ করতেন।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কক্ষে মানুষের ভিড়। এ সময় পিরোজপুর এলাকার ফাতেমা ফারজানা বলেন, ‘আমার বাবার মৃত্যু নিবন্ধন সনদ দরকার। দেড় মাসের বেশি সময় ধরে আসছি। প্রতিদিনই বলে কাল-পরশু পাবেন। কতদিন ঘুরতে হবে জানি না।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ফি অনলাইনে নেয় সরকার। এ জন্য সার্ভারে চারঘাট পৌরসভার আইডি রয়েছে বাচ্চুর নামে। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় ধরে নিবন্ধনের কোনো টাকা পৌরসভার অ্যাকাউন্টে জমা হয়নি। সরকারি ফান্ডেও যায়নি। প্রায় ৪ লাখ টাকা তিনি নিজের কাছে রেখেছেন। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে পৌরসভার আইডি বন্ধ রেখেছে। ফি পরিশোধ করে আইডি ফেরত পেলে নিবন্ধন শুরু হবে।
পৌরসভা সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট তৎকালীন মেয়র একরামুল হক গা-ঢাকা দেন। তবে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত অফিসে এসেছেন হিসাবরক্ষক বাচ্চু। এ সময়ে ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা বা অন্য কাউকে না জানিয়ে ৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন তিনি। ১০ দিনে মার্কেট তহবিল থেকে ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৬০০, ট্যাক্স ও ট্রেড তহবিল থেকে ৩৬ হাজার ৫০০, কর তহবিল থেকে সাড়ে ১০ হাজার এবং ভূমি হস্তান্তর কর, পানি ও কল্যাণ তহবিল থেকে ১৮ হাজার ৪০০ টাকা তোলা হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট পৌরসভায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলে সংস্কারের খরচ হিসেবে আরও আড়াই লাখ টাকা নিজের কাছে রেখেছেন হিসাবরক্ষক বাচ্চু। সূত্র জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পৌরকর তহবিলে ১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা জমা হয়েছে। এডিবি, কর্মচারীদের সরকারি বেতন সহায়তা এবং হাট ও বালুঘাট ইজারা থেকে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা জমা হয়। এ সাড়ে ৩ কোটি টাকা থেকে ২৮ জন স্থায়ী ও ২২ জন দৈনিক মজুরির কর্মচারীকে মাসে সাড়ে ১২ লাখ টাকা বেতন-ভাতা পরিশোধ করে কর্তৃপক্ষ। এক বছর বেতন দেওয়ার পরও অন্তত দেড় কোটি টাকা ফান্ডে থাকার কথা। অথচ নতুন অর্থবছরের তিন মাস না যেতেই ফান্ডে টাকা নেই। ফলে ৫ আগস্টের পর দুই মাস বেতন-ভাতা দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। টাকার কোনো হদিস নেই।
হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা অনুপস্থিত থাকায় পৌর ক্যাশিয়ারকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দিতে নির্দেশনা দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। গত ১৫ সেপ্টেম্বর বাচ্চুর কক্ষের তালা ভেঙে ক্যাশিয়ারকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় তাঁর ব্যক্তিগত ড্রয়ারে সারদা এক্সপ্রেস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ১০ লাখ টাকার চেক উদ্ধার করা হয়েছিল। পরে চেক ব্যাংকে জমা দিয়ে পৌরসভার অ্যাকাউন্টে টাকা রাখা হয়েছে।
নগর পরিচালনা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পৌরসভায় সাত হাজার ডাস্টবিন বিনামূল্যে বিতরণের জন্য আসে। তবে বড়গুলো ৩০০ ও ছোটগুলো ১০০ টাকা হিসেবে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে বিক্রি করা হয়। বিক্রির প্রায় ১২ লাখ টাকা হিসাব বিভাগ আদায় করলেও অ্যাকাউন্টে জমা হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেও স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ায় বাচ্চুর ক্ষমতা কমেনি। দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকলেও তাঁকে শোকজ করার সাহস পায়নি কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এম এস আসাদ উজ জামান বাচ্চুর মোবাইল ফোনে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তাঁর অফিসেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) রেজাউল করিম বলেন, ৫ থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে উঠেছে। এ বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের আইডি সচলের চেষ্টা চলছে। হিসাবরক্ষকের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পৌরসভায় সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক এবং ইউএনও সানজিদা সুলতানা বলেন, অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
- বিষয় :
- পৌরসভা