ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

অনিয়মে নিয়োগ ১৪ কর্মকর্তার পদোন্নতিতেও জালিয়াতি

অনিয়মে নিয়োগ ১৪ কর্মকর্তার পদোন্নতিতেও জালিয়াতি

.

 আহমেদ কুতুব, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:২৬ | আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৫০

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি-পরীক্ষা ছাড়াই সরাসরি নিয়োগ পেয়েছিলেন রাষ্ট্রয়াত্ত প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড বা এসএওসিএলের ১৪ কর্মকর্তা। এ অবস্থায় চার বছর আগে বাণিজ্যিক অডিট আপত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও পরবর্তী সময়ে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। এবার তাদের পদোন্নতি দিতে তোড়জোড় চলিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরশেন বা বিপিসির এ অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক থেকে হালনাগাদ ছাড়পত্র না নিয়েই পুরোনো ছাড়পত্র দিয়ে এ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। অথচ তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই দুদক অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত চলাচ্ছে।
দুদক চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এর উপপরিচালক মো. নাজমুছায়াদাত বলেন, এসএওসিএলের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে। এ অবস্থায় দুদক থেকে হালনাগাদ তথ্য না নিয়ে পুরোনো ছাড়পত্র দিয়ে পদোন্নতি দেওয়ার কৌশলটিও এক ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি। হালনাগাদ তথ্যের ভিত্তিতে ছাড়পত্র নিতে অসুবিধা কোথায়? এ-সংক্রান্ত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নতুন দায়িত্ব নেওয়া এসএওসিএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফেরদৌসী মাসুম হিমেল বলেন, এসব অনিয়ম-দুর্নীতি সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো বিবেচনায় নিয়েই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
জানা যায়, এসএওসিএলের সদ্য সাবেক সিইও মণি লাল দাশের আমলে এসব পদোন্নতির উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনি জানান, ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১০৫ জনের নিয়োগ হয়েছে নিয়ম না মেনে। তাদের মধ্যে এই ১৪ জন আছেন। অডিট আপত্তির বিষয়টি সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ও অবগত। পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা তাঁর আমলে শেষ হয়নি। 
সিনিয়র অফিসার শহিদুল ইসলাম ও জুনিয়র অফিসার দুর্জয় দে বলেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই তারা নিয়োগ পেয়েছেন। কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি। এখন কর্তৃপক্ষই আইন মেনে পদোন্নতি দিচ্ছে। অনিয়মে চাকরি পেয়ে থাকলে বিষয়টি কর্তৃপক্ষ দেখবে। একই বক্তব্য দেন অন্য কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম, আনোয়ার জাহিদ, প্রলয় চক্রবর্তীও। 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিতর্কিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে ১৪ কর্মকর্তার দুর্নীতির ছাড়পত্র পেতে বিপিসিকে চিঠি লেখে এসএওসিএল। বিপিসি সেই চিঠি মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মন্ত্রণালয় দুদক থেকে হালনাগাদ তথ্য না নিয়ে ২০২৩ সালের পুরোনো তথ্যের ভিত্তিতে দুদকের দেওয়া চিঠির সূত্র উল্লেখ করে বিপিসিতে ফেরত জবাবি চিঠি পাঠায়। এভাবেই অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদোন্নতি দিতে কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি-পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ পেয়ে পদোন্নতি পেতে যাওয়া কর্মকর্তারা হলেন– সিনিয়র অফিসার (মেইনটেন্যান্স) শহিদুল ইসলাম, জুনিয়র অফিসার (টেকনিক্যাল) দুর্জয় দে, অফিসার (হিসাব) ফখরুল ইসলাম, টেকনিক্যাল অফিসার আনোয়ার জাহিদ, সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রকৌশল) প্রলয় চক্রবর্তী, জুনিয়র সেলস অফিসার শাহাদাত হোসেন, উপব্যবস্থাপক (প্রকৌশলী ও অপারেশনস) মোকাররম হোসেন, উপব্যবস্থাপক (হিসাব) মাহমুদুল হক, জুনিয়র অফিসার (অপারেশন) শামীম সহিদ, টেকনিক্যাল অফিসার আনিসুর রহমান, অফিসার (এইচআর) আবদুল্লাহ আল মামুন, অফিসার (সেলস) মীর হোসেন, ম্যানেজার (প্রোডা. ও অপা.) ছিদ্দিকুর রহমান ও অফিস সহকারী আশরাফ উদ্দিন।
২০২০ সালের ১১ নভেম্বর জমা দেওয়া নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সিনিয়র অফিসার শহিদুল ইসলাম সম্পর্কে বলা হয়, তাঁকে শুধু আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁর কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। নিয়োগের সময় তাঁর বয়স ছিল ৩০-এর  বেশি। এ ক্ষেত্রে অস্থায়ী নিয়োগের শর্ত ভঙ্গ হয়েছে। জুনিয়র অফিসার দুর্জয় দে সম্পর্কে বলা হয়, তাঁর আবেদনের তারিখের আগেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁকে একাধিকবার ক্যাজুয়াল নিয়োগ দেওয়া হয়। অফিসার ফখরুল ইসলাম ভূঁইয়াকে স্থায়ী করার ক্ষেত্রে ৮৯ দিনের শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে। অভিজ্ঞতা ছাড়াই তাঁকে প্রজেক্টে নিয়োগ করা হয়। তিনি তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহেদের চাচাতো বোনের জামাই। 
টেকনিক্যাল অফিসার আনোয়ার জাহিদকে শুধু আবেদনের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। সহকারী ব্যবস্থাপক প্রলয় চক্রবর্তীকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শুধু আবেদনের ভিত্তিতে। তাঁর মেডিকেল রিপোর্টে কোলেস্টেরল, এলডিএল, এইচডিএল ও টিজি রেফারেন্স ভ্যালুর চেয়ে কম-বেশি ছিল। একই অবস্থা জুনিয়র সেলস অফিসার শাহাদাত হোসেনের ক্ষেত্রেও। এ ছাড়া মোকাররম হোসেনকে আবেদনের ভিত্তিতে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই সরাসরি উপব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। মোকাররম প্রয়াত মহাব্যবস্থাপক শাহেদের ভাগনে। 
একই কায়দায় নিয়োগ পান উপব্যবস্থাপক (হিসাব) মাহমুদুল হকও। জুনিয়র অফিসার অপারেশন শামীম সহিদকে বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের এক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গায়েব করার অভিযোগ তোলে অডিট আপত্তিতে। টেকনিক্যাল অফিসার আনিসুর রহমান, অফিসার আবদুল্লাহ আল মামুন, অফিসার মীর হোসেন ও অফিস সহকারী আশরাফ উদ্দীনকেও সরাসরি বিজ্ঞপ্তি-পরীক্ষা ছাড়া সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়। 

আরও পড়ুন

×