শরীর মরছে অপুষ্টিতে, মন মরছে বৈরী পরিবেশে

ছবি: সমকাল
হাসান হিমালয়, খুলনা
প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৪:৫৭ | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৩:২১
জরাজীর্ণ দোতলা ভবনের নিচের অংশ কাপড় দিয়ে ঘেরা। পুরোনো জং-ধরা লোহার সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠে দেখা গেল বড় দুটি ঘর। জানালা ভাঙা। এলোমেলোভাবে পেতে রাখা চৌকিতে তেলচিটে বালিশ না থাকলে বোঝার উপায় ছিল না যে, এখানে মানুষ থাকে। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার উলা গ্রামের ‘মাজিদীয়া এতিমখানা’র শিশুদের থাকার জায়গা এটি। ঝুঁকিপূর্ণ ওই ঘরে থাকে ৯টি শিশু। খুলনা নগরীর সবুজবাগ এলাকার ‘ওমর ফারুক মাদ্রাসা ও এতিমখানা’র ভবন কিছুটা নতুন। তৃতীয় তলায় শিশুদের থাকার জায়গা। সেখানেও দেখা গেল, সারি সারি চৌকি পাতা। কোনোটিতে কম্বল, কোনোটিতে তোশক বিছানো। বিভিন্ন জায়গায় দড়িতে ঝুলছে শিশুদের লুঙ্গি, গামছা। এখানেও গাদাগাদি করে থাকে ৩০টি শিশু।
শুধু এ দুটিই নয়, খুলনা জেলার বেশির ভাগ এতিমখানার দৃশ্যই কমবেশি এমন। বিশ্বজুড়ে যেখানে অন্যতম আলোচিত শব্দ ‘শিশু অধিকার’; সরকারের পাশাপাশি জাতিসংঘসহ অনেক বেসরকারি সংস্থা যেখানে শিশুদের কল্যাণে ব্যয় করছে বিপুল অর্থ; সেখানে এতিমখানার শিশুরা কেমন আছে– দেখতে অনুসন্ধানে নামে সমকাল।
গত চার মাসে খুলনার নগর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের ৫৫টি এতিমখানা ঘুরে দেখা হয়। যেসব দৃশ্য চোখে পড়ে; যেসব তথ্য উঠে আসে, তা এককথায় ‘মন খারাপ করা’। পুষ্টিকর খাদ্য, বস্ত্র, আবাসন, চিকিৎসা, সুশিক্ষার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই বড় হচ্ছে এতিমখানার শিশুরা। বড় অযত্ন-অবহেলা-অনাদরে দিন পার করছে ওরা। বেশির ভাগ এতিমখানায় অন্ধকার-অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে রাখা হয় শিশুদের। খেলার জন্য বিকেলে এক ঘণ্টারও কম সময় দেওয়া হয়। ২৩ ঘণ্টাই কঠোর রুটিনের মাঝে বন্দি থাকতে হয়। ফলে সহজাত প্রতিভা বিকশিত হচ্ছে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিশুদের এই দুরবস্থার মূলে রয়েছে অব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাব। এতিমখানা প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনার কোনো বিধিবদ্ধ নিয়ম নেই। যে কেউ ইচ্ছা করলেই একটা এতিমখানা চালু করে দিতে পারেন। এগুলো নিয়ন্ত্রণেরও কেউ নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধিত এতিমখানা পরিচালনার কিছু নিয়ম থাকলেও মানা হয় না।
খুলনায় শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং লেখাপড়া নিয়ে দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে। অথচ জেলার ৫৫টি এতিমখানা ঘুরে কোথাও সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার তৎপরতা দেখা যায়নি। বেশি বঞ্চিত কন্যাশিশুরা। মেয়েদের এতিমখানা হাতেগোনা কয়েকটি। সেখানে খেলাধুলা তো দূরের কথা, বাইরে বের হওয়াই নিষেধ ওদের।
খুলনায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধিত ৭৩টি এতিমখানার মধ্যে মেয়েদের পৃথক এতিমখানা নেই। এই অধিদপ্তর জেলার ৬৭টি এতিমখানার ১ হাজার ৭৪৩ শিশুর খাওয়া ও অন্যান্য খরচের জন্য প্রতি মাসে মাথাপিছু দুই হাজার টাকা অনুদান দেয়। এর মধ্যে ছয়টি এতিমখানায় মাত্র ১৯ কন্যাশিশু এই অনুদান পায়। অবশ্য তারা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকে।
এতিমখানায় কত শিশু?
খুলনায় ঠিক কতগুলো এতিমখানা আছে, তার সঠিক তথ্য কারও কাছে নেই। জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধিত ৭৩টির বাইরে আরও অনেক এতিমখানার কথা জানা গেলেও সেই তথ্য সরকারি সংস্থাগুলোর অজানা। এগুলোর বেশির ভাগই কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক। প্রায় প্রতিটি কওমি মাদ্রাসা ও হেফজ মাদ্রাসায় এতিমখানা আছে। এতিম শিশুদের পাশাপাশি নিম্নআয়ের পরিবারের শিশুরাও সেখানে থাকে। এগুলোকে বলা হয় লিল্লাহ বোর্ডিং।
খুলনায় কতটি কওমি মাদ্রাসা আছে, সেই তথ্যও নেই জেলা প্রশাসনের কাছে। পরে কওমি ধারার ৬টি শিক্ষা বোর্ডে আলাদাভাবে খোঁজ নিয়ে জেলায় ২২২টি কওমি মাদ্রাসার তথ্য পাওয়া গেছে। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ বোর্ডের আওতায় খুলনায় মাদ্রাসা রয়েছে ১১১টি। এর মধ্যে ছেলেদের ৬৮টি এবং মেয়েদের ৪৩টি। বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙ্গার অধীনে মাদ্রাসা রয়েছে ৫৭টি; কোরআন শিক্ষা বোর্ডের অধীনে রয়েছে ১২০টি। এ ছাড়া আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তালীম বাংলাদেশ, তানযীমুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া বাংলাদেশ ও জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে আরও অর্ধশত কওমি মাদ্রাসা রয়েছে।
বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বোর্ডের খুলনা অঞ্চলের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হাফেজ মাসউদুর রহমান বলেন, ৯৫ ভাগ কওমি মাদ্রাসায় লিল্লাহ বোর্ডিং আছে। সেখানে দুস্থদের সঙ্গে এতিম শিশুরা থাকে। তবে ছাত্রের সংখ্যা সব মাদ্রাসায় পৃথকভাবে খোঁজ নিয়ে জানতে হবে।
কওমি ধারার বাইরে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ৩৮টি মাদ্রাসায় এতিমখানা আছে খুলনায়। এর মধ্যে মেয়েদের মাদ্রাসা ৫টি। কুয়েতের উন্নয়ন সংস্থা পরিচালিত দুটি, মধ্যপ্রাচ্যের সহযোগিতায় আরও ৪টি এতিমখানার তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরে খুলনায় ছেলে ও মেয়েদের জন্য সরকারি দুটি শিশু পরিবার রয়েছে। এ ছাড়া খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের সেন্ট জোসেফস চার্চ ও তাদের পরিচালিত কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থায় আরও কিছু দুস্থ শিশু-কিশোর থেকে লেখাপড়া করে। সেই হিসাবে জেলায় অন্তত ২৫০টি এতিমখানা আছে বলে অনুমান করা যায়।
সরেজমিন দেখা গেছে, খুলনার মাদ্রাসাগুলোতে সর্বোচ্চ ৮০০ থেকে সর্বনিম্ন ২০ জন পর্যন্ত লেখাপড়া করে। আর এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থাকে সর্বোচ্চ ৭০০ থেকে সর্বনিম্ন ৯ জন পর্যন্ত। গড়ে ৪০ করে হিসাব করলে খুলনার এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে বড় হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার শিশু।
পুষ্টিহীন রুগ্ণ শরীর
এতিমখানার শিশুর ৯০ ভাগের বয়সই ১৫ বছরের নিচে। সমকালের পক্ষ থেকে ওয়েট মেশিন ও গজ ফিতা নিয়ে কয়েকটি এতিমখানায় শিশুর ওজন ও উচ্চতা পরিমাপ করা হয়। স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী বেশির ভাগেরই বয়সের তুলনায় ওজন ও উচ্চতা কম পাওয়া যায়।
এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ এতিমখানায় বাঁচিয়ে রাখার জন্য ন্যূনতম খাবারের ব্যবস্থা থাকে। পুষ্টিকর বা সুষম খাবার নেই। গত চার মাসে খুলনা মহানগরী ও জেলার ৯টি উপজেলার ৫৫টি এতিমখানায় গিয়ে ২৮০ শিশুর সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তবে নিরাপত্তা ও বয়স বিবেচনায় নাম উহ্য রাখা হলো।
খুলনা নগরীর গোয়ালখালীতে জামিয়া রশিদিয়া মাদ্রাসার লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানায় গিয়ে দেখা গেল, দুপুরে শিক্ষার্থীদের জন্য রান্না হচ্ছে শুধু সবজি। শিশুরা জানায়, প্রতিদিন সকালে ভাত ও ডাল থাকে। সপ্তাহে এক দিন দুপুরে গরু বা মুরগির মাংস, এক দিন মাছ, এক দিন ডিম, এক দিন মুরগির মাংস এবং বাকি তিন দিন সবজি থাকে। সপ্তাহে সাত দিনই রাতে ভাতের সঙ্গে ডাল অথবা সবজি থাকে। সারাবছর ধরে চলে এই রুটিন। এর বাইরে মাঝে মাঝে দাওয়াত থাকে। ওইদিন খাওয়া ভালো হয়।
মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা ওমর আহমেদ বলেন, প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থীর জন্য প্রতিদিন তিনবেলা রান্না হয়। অনেকে সামান্য কিছু করে টাকা দেয়। তবে গরিব, অসহায় ও এতিম শিশুরা ফ্রি খায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রতিবেলায় ভালো খাবার দেওয়া কষ্টকর।
গ্রামের এতিমখানায় খাবারের চিত্রও একই রকম। ডুমুরিয়া উপজেলার ভান্ডারপাড়া মাওলানা এলাহী এতিমখানায় গিয়ে দেখা যায়, তাদের বোর্ডিংয়ে প্রতিদিন ৪৭ শিশু খাওয়া-দাওয়া করে। প্রতিদিন সকালে ভাত, আলু ভর্তা ও ডাল, প্রতি রাতে সবজি এবং দুপুরে দুই দিন মাছ, এক দিন ডিম ও বুধবার মাংস রান্না হয়।
মাদ্রাসার মুহতামিম হাফেজ এনায়েত আহমেদ বলেন, গ্রামের অধিকাংশ লোক গরিব। তারা বেশি কিছু দিতে পারে না। প্রায় সব মাদ্রাসার মেন্যুই একই রকম।
জেলার ১০টি এতিমখানার শিশুদের খাবারের ধরন, পরিমাণ ও ওজন সংগ্রহ করে উপস্থাপন করা হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কেসিসি উইমেন্স কলেজের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. নাসরীর নাহার বেগমের কাছে। ক্যালরিভিত্তিক পুষ্টি বিভাজন করে তিনি জানান, এই শিশুদের খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত শর্করা রয়েছে। আয়রনের জোগানও ঠিক আছে। তবে শরীরের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ আমিষ এবং বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন বাড়ানো দরকার।
প্রবীণ এই পুষ্টিবিদ সমকালকে বলেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশু-কিশোরদের ক্যালরিসমৃদ্ধ প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রনসহ বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া দরকার। তিনি বলেন, শিশুরা অপুষ্টির শিকার হলে এটি শুধু তাদের শারীরিকভাবে প্রভাবিত করে না, তাদের একাডেমিক এবং জ্ঞানীয় দক্ষতার ওপরও প্রভাব ফেলে।
একই প্রতিষ্ঠানের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহনাজ শামসী এতিমখানার শিশুদের খাদ্য তালিকা শুনে তিনি দুধ, ডিম, লেবুসহ মৌসুমি ফল খাওয়ানোর তাগাদা দেন।
এই দু’জন পুষ্টিবিদের মতামত নিয়ে আলোচনা করতে গেলে রূপসা উপজেলার একটি এতিমখানার পরিচালক হেসে ফেলেন। নাম গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও ৯ বছর মাদ্রাসার ছাত্র ছিলাম। তখনও এসব খাবারই খেয়েছি। এখনও একই মেন্যু চলছে। পুষ্টি, আমিষ এসব নিশ্চিত করতে গেলে আগে সংশ্লিষ্টদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে।
অপরিচ্ছন্ন বন্দি জীবন
খুলনা নগরীর হাজি মালেক এতিমখানায় গিয়ে দেখা যায়, লম্বা একটি ঘরে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে সারি সারি চৌকি পাতা। ছাদে ড্যাম, তাই সব জায়গায় ফ্যান নেই। এর মধ্যেই গাদাগাদি করে থাকে ৩৩ শিশু। মুহাম্মদনগর মহিলা কামিল মাদ্রাসায় রয়েছে ‘খন্দকার আব্দুস সাত্তার বালিকা ইয়াতিমখানা’। সেখানে দুস্থ ও এতিম মিলিয়ে ৩০ কন্যাশিশু থাকে। ভবন পাকা হলেও প্রায় অন্ধকার ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হয় মেয়েদের।
গত ১১ নভেম্বর নগরীর রায়ের মহল এলাকার ওমর ফারুক মাদ্রাসা ও এতিমখানায় গিয়ে দেখা যায়, ভবনে তালাবদ্ধ। ভেতরে শিশু-কিশোররা লেখাপড়া করছে। বেশির ভাগই হেফজ বিভাগের ছাত্র।
ইখড়ি নেবুদিয়া ইসলামিয়া এতিমখানায় গিয়েও দেখা যায়, মূল ফটকে তালা ঝোলানো। আর ভেতরে লেখাপড়া করছে শিশুরা।
হেফজ বিভাগের শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের দৈনন্দিন রুটিন। যেমন– ভোর সাড়ে ৪টায় ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা। ফজরের নামাজ শেষে আবার পড়তে বসা। সকাল ৭টায় নাশতার জন্য ২০ মিনিটের বিরতি। এরপর আবার পড়া। সকাল ৯টায় নাশতা খাবারের পর ঘুম। ১২টায় ঘুম থেকে উঠে গোসল করে নামাজের পর দুপুরের খাবার। ৩টায় আবার পড়তে বসা। আসরের নামাজের পর অল্প সময় খেলার বিরতি। মাগরিবের ১০ মিনিট আগে ফিরে এসে নামাজ শেষে আবার পড়তে বসা। রাত ৯টায় এশার নামাজের পর খাওয়া এবং রাত ১০টায় ঘুমাতে যাওয়া। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই শিশুরা খেলার জন্য সময় পায় ৪০ থেকে ৫০ মিনিট। এর মধ্যে বেশ কিছু মাদ্রাসায় ফুটবল ও কাবাডি খেলা নিষেধ। তবে গ্রামের কয়েকটি এতিমখানায় গিয়ে কোনো ধরনের রুটিন দেখা যায়নি। সেখানে অবশ্য তদারকির মতো শিক্ষকও নেই। একজন শিক্ষকই একটি মাদ্রাসা-কাম-এতিমখানা পরিচালনা করছেন– এমন দেখা গেছে আটটি মাদ্রাসায়।
আদর-ভালোবাসাহীন শৈশব
গত চার মাসে বিভিন্ন লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানা ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ শিক্ষক শিশুদের সঙ্গে স্নেহসুলভ ব্যবহার করেন না। কড়া নিয়ম ও শাসনের মধ্যে শিশুরা বড় হচ্ছে। পারিবারিক পরিবেশ নেই কোথাও। দীর্ঘ সময় শিশুদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, শিশু-কিশোররা অনেকটা অন্তর্মুখী হয়ে থাকে। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কেসিসি উইমেন্স কলেজের শিশু বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান ড. সাধিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে। সমকালকে তিনি বলেন, বাবা-মা অথবা পরিবারহীন শিশুগুলো আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। কষ্ট চেপে রাখতে রাখতে একসময় তারা কঠোর হয়ে যায়। মানুষের প্রতি তাদের বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয়। তখন অন্যের প্রতি হিংসাত্মক মনোভাব দেখায়।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. মোহাম্মদ হাসান বলেন, শিশুদের মানসিক বিকাশ সুস্থ-স্বাভাবিক করার জন্য বাবা-মাসহ চারপাশের মানুষের আচরণ আর শিশুর পারিপার্শ্বিক পরিবেশও সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখতে হবে। অস্বাভাবিক পরিবেশ সুস্থ মানসিকতার শিশু উপহার দিতে পারে না। এর কোনোটিই এতিমখানার শিশুদের ক্ষেত্রে হচ্ছে না।
ওরা কেন পরিকল্পনার বাইরে?
শিশু সংগঠক ও খুলনা খেলাঘর আসরের সভাপতি মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, ১৯৯১-৯২ সালে কিছুদিন মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলাম। তখনও শিশুরা সকালে আলু ভর্তা, ডাল খেত। কয়েক দিন আগে একটি কাজে সেই মাদ্রাসায় গিয়ে দেখি, এখনও সকালে আলু ভর্তা-ডাল চলছে। মাদ্রাসা যারা চালান, তাদের ভাবনায় পরিবর্তন আসেনি। সমাজ, সরকার কেউই ভাবনা পরিবর্তনে এগিয়ে আসেনি।’
এই সংগঠক আরও বলেন, ‘একইভাবে আমাদের সমাজে বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, ওদের জন্য অনেক সাহায্য আসে, ওরা ভালো আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় এর উল্টো।
তেরখাদা উপজেলার নেবুদিয়া ইসলামিয়া এতিমখানার পরিচালক আলিমুল ইসলাম ১৮ বছর আগে ওই মাদ্রাসাতেই লেখাপড়া করেছেন। সমকালকে তিনি বলেন, ‘আমরাও এভাবে বড় হয়েছি। এই খাবার, লেখাপড়া– এভাবেই ওস্তাদরা শিখিয়েছেন। এখন অবশ্য ভবন, টয়লেট, গোসলখানা আধুনিকায়ন হয়েছে, কিন্তু পরিচালনা নীতি আগের মতোই আছে।’
শিশুদের নিয়ে কাজ করা ২০টি সংগঠনের মোর্চা ‘শিশু সুরক্ষা জোট, খুলনা’র সভাপতি শামীমা সুলতানা শিলু বলেন, ‘এ পর্যন্ত শতাধিক অনুষ্ঠান করেছি। সেখানে সরকারি শিশু পরিবারের বাচ্চারা থাকলেও কোথাও কওমি মাদ্রাসা বা এতিমখানার শিশুদের দেখিনি। সেখানকার পরিচালকরা শিশুদের মূলধারায় আনতে চান না, তারা নিজেরাও আসেন না। সরকারিভাবেও এমন উদ্যোগ নেওয়া হয় না। এসব শিশুর অধিকার রক্ষায় দুই পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে।’
করণীয় কী?
শিশু সুরক্ষা জোট, খুলনার সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আজম ডেবিট সমকালকে বলেন, সবার আগে প্রয়োজন সরকার ও আলেম সমাজের সদিচ্ছা এবং মানুষের সচেতনতা। এনজিওসহ সমাজের বড় একটি অংশ মাদ্রাসা নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। তারা এতিম শিশুদের বিষয় মূল ধারায় আনতে চান না; মাদ্রাসার শিক্ষকরাও তাদের গণ্ডি থেকে শিশুদের ছাড়তে চান না। এখানে উভয় পক্ষের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করা প্রয়োজন।
এই সংগঠকের দ্বিতীয় পরামর্শ হলো, ইচ্ছা হলেই মা-বাবার নামে এতিমখানা চালুর ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এতিমখানা চালুর জন্য যুগোপযোগী নীতিমালা তৈরি করতে হবে। সেখানে শিশুদের থাকার ব্যবস্থা, খাবার, লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্যান্য কারিকুলাম কী হবে, সবকিছু উল্লেখ থাকবে। সেগুলো নিশ্চিত করার পরেই প্রতিষ্ঠান চালু হবে। এতিমখানা পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি অংশগ্রহণ ও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
সচেতন নাগরিক কমিটি, খুলনার সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা সমকালকে বলেন, ‘আমাদের দেশের মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো ধর্মীয় আবেগ দিয়ে পরিচালিত হয়। তাই এতিমখানা সংস্কারের জন্য সবার আগে ধর্মীয় নেতাদের উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ধর্মীয় নেতা, আলেম, মাদ্রাসার পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং মোটিভেশন করতে হবে। তাদের সঠিকভাবে শিশু অধিকারের বিষয়টি বোঝাতে পারলে অনেক কিছুই সহজ হবে।
কেসিসি উইমেন্স কলেজের শিক্ষক ড. সাধিনা ইয়াসমিন বলেন, এতিমখানাগুলোতে শিশুদেরকে পরিবারের আদরে বড় করতে হবে। কোনোভাবেই তারা যেন আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত না থাকে। মানবীয় গুণ না পেলে ধর্মীয় জ্ঞান এক সময় কাজে লাগবে না। তাই সরকারি-বেসরকারি সব পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি।
{ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) দুর্নীতিবিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ফেলোশিপ-২০২৪ এর আওতায় প্রতিবেদনটি করা হয়েছে।}
- বিষয় :
- খুলনা
- এতিমখানা
- সমাজসেবা অধিদপ্তর