ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

মুদি দোকানি ৩০ কোটি টাকা ঋণের জামিনদার

চট্টগ্রামে বসে ঢাকায় জালিয়াতি

মুদি দোকানি ৩০ কোটি টাকা ঋণের জামিনদার

.

আহমেদ কুতুব, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:২৬

চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বাংলাবাজারে মুদি দোকান ফারুকুল ইসলামের। সেখানেই ফটোকপিসহ স্টেশনারি সরঞ্জাম বিক্রি করেন। একার আয়ে সংসার না চলায় স্ত্রীকে দেন গার্মেন্টে চাকরি। অভাব থাকলেও সাত সদস্য নিয়ে সুখে ছিল ফারুকুল দম্পতি। সম্প্রতি ৩০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধে ঢাকার একটি ব্যাংকের চিঠি পেয়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে ফারুকুলের। আরও অবাক হয়েছেন, নুন আনতে যার পান্তা ফুরোয়, তাঁকেই জালিয়াত চক্র একটি ডেভেলপার কোম্পানির চেয়ারম্যান বানিয়েছে দেখে!
ভুক্তভোগী ফারুকুল জানান, জীবনে কখনও তাঁর ঢাকা যাওয়ার ভাগ্য হয়নি। অথচ রাজধানীকেন্দ্রিক ‘ডায়মন্ড রিজ কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’-এর চেয়ারম্যান করা হয়েছে ফারুকুলকে। জামিনদার (গ্যারান্টার) করে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) রাজধানীর বনানী ১১ শাখা থেকে প্রতারক চক্র ৩০ কোটি ২৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে।

ভুয়া চেয়ারম্যান বানানো ও ঋণের জামিনদার করার পেছনে চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য এস এম আল মামুনের ভাই এস এম আল নোমান এবং তাঁর সহযোগী আবুল হোসেনের কারসাজি রয়েছে বলে মনে করেন ফারুকুল।
তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগে স্থানীয় আবুল হোসেনের মাধ্যমে আল নোমান স্ত্রীসহ আমার ছবি ও এনআইডি নেন ডায়মন্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পলিসি করার জন্য। কিন্তু তারা পলিসি না করে আমাকে কোম্পানির ভুয়া চেয়ারম্যান বানিয়ে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। ব্যাংকের চিঠি পাওয়ার পর বিষয়টি জানতে পেরেছি। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলা করেছি। অভিযোগ দিয়েছি বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকে।’
একই বাজারের সোহেল টেলিকমের কর্ণধার মো. সোহেল বলেন, ‘আবুল হোসেন আমার দোকান থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা দিয়ে ফারুকুলসহ ছয়জনের নামে সিম কেনেন।’
অভিযুক্ত এস এম আল নোমানের পক্ষে কাজ করা আবুল হোসেন বলেন, আমি ও ফারুকুল পলিসি করতে নোমানের কাছে ছবি ও কাগজপত্র দিয়েছি। কিন্তু ফারুকুল কীভাবে কোম্পানির চেয়ারম্যান হয়েছেন, আমি জানি না।
ইউসিবি ব্যাংক ঢাকার বনানী ১১ শাখার অপারেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ সোবহান মিয়া বলেন, ‘আমরা ডায়মন্ড রিজ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়মনীতি মেনে তাঁকে ঋণ দিয়েছি।’

যেভাবে সামনে এলো জালিয়াতি
৫ আগস্টের পর থেকে আত্মগোপনে সাবেক এমপি এস এম আল মামুন, ভাই এস এম আল নোমানসহ পরিবারের সদস্যরা। গত ১০ নভেম্বর ফারুকুল ইসলামের চট্টগ্রামের ঠিকানায় ইউসিবি ব্যাংক ঢাকা থেকে একটি চিঠি আসে। এতে ফারুকুলকে ডায়মন্ড রিজ কনস্ট্রাকশন কোম্পানির চেয়ারম্যান উল্লেখ করে জামিনদার হিসেবে তাঁকে ৩০ কোটি ২৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৪৮ টাকা ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ঠিকাদারি কাজের আদেশ অর্থায়নে (ডব্লিওএফ লোন) ২০ কোটি, বিজি লোন ৫ কোটি ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য টাইম লোন ৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ২৫ জুন ব্যাংক এ ঋণ মঞ্জুর করে।

প্রতারণার ফাঁদ বিছান নোমান
ফারুকুল চট্টগ্রামের বাজার ডেবারপাড় মাস্টার কলোনির বাসিন্দা। কলোনির সামনে ১৫ বছর ধরে মুদি ও ফটোকপির দোকান চালান। একই এলাকার বাসিন্দা আবুল হোসেন প্রায়ই ফটোকপি করতে আসতেন। এভাবে দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর আবুল জানান, তিনি সীতাকুণ্ডের সাবেক এমপি এস এম আল মামুন ও তাঁর ভাই এস এম আল নোমানের গাড়ি চালান। এক পর্যায়ে এমপি মামুনের ডায়মন্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সে এক বছর মেয়াদি ১ লাখ টাকার পলিসি করতে বলেন। দুই বছর পর তা দ্বিগুণ হবে বলে জানান আবুল হোসেন। তিনি আরও ছয়জন গ্রাহক সংগ্রহ করেন। পরে সোহেল টেলিকম থেকে প্রত্যেকের নামে রবি সিম কেনেন। এগুলো চালু করার পর নিয়ে যান আবুল হোসেন। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর আবুল হোসেন হঠাৎ দোকানে এসে ফারুকুলের এনআইডি ও যাকে নমিনি করবেন, তাঁর এনআইডির ফটোকপি নিয়ে যান। কিন্তু দীর্ঘদিনও ফারুকুল পলিসির কোনো নথিপত্র পাননি।
কথিত কোম্পানির ভুয়া চেয়ারম্যান বানানো ও ঋণের জামিনদার করার পেছনে চারজনের কারসাজি রয়েছে বলে মনে করছেন ফারুকুল। তিনি জানান, আবুল হোসেন, সাবেক এমপি আল মামুন, তাঁর ভাই আল নোমান এবং নোমানের পিএস মো. রিমন পলিসি করার কথা বলে স্বাক্ষর, ছবি ও এনআইডির ফটোকপি নিয়েছেন।

আরও পড়ুন

×