ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

সিলেটে টিয়া হাজির দাদনে নিঃস্ব মানুষ

সিলেটে টিয়া হাজির দাদনে নিঃস্ব মানুষ

তজমুল হোসেন

 সিলেট ব্যুরো

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ০১:০২

সরকারি কর্মচারী বশির আহমদকে জামিনদার করে সুদে পাঁচ লাখ টাকা নেন তাঁর আত্মীয় কুতুব মিয়া। তজমুল হোসেন ওরফে টিয়া হাজিকে প্রতি মাসে লাখে পাঁচ হাজার টাকা নিয়মিত দিতে পারেননি কুতুব। পরে তজমুল চাপ দেন বশিরকে। চাকরি ও সম্মান রক্ষায় হাউস বিল্ডিং থেকে ঋণ করে পাঁচ লাখ টাকাই দেন বশির। অথচ তাঁকেই ২৫ লাখ টাকা পরিশোধে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছেন তজমুল।
একই ঘটনা মিনতি রায়ের ক্ষেত্রেও। তজমুলের কাছ থেকে এক লাখ টাকা ধার নিয়ে পরে পরিশোধও করেন। তাঁকেও সাত লাখ টাকা পরিশোধে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছেন তজমুল।
এলাকায় কখনও সুদে, কখনও ধারের নামে টাকা দিচ্ছেন তজমুল। এ সময় স্বাক্ষর করা ব্ল্যাংক চেক রাখেন। পরে ইচ্ছেমতো অঙ্ক বসিয়ে উকিল নোটিশ ও মামলা করছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ 
করেছেন। তজমুলের দাদনের খপ্পরে পড়ে সিলেটের জৈন্তাপুরের চিকনাগুল ইউনিয়নে শত শত মানুষ নিঃস্ব হয়েছেন। অনেকেই ছেড়েছেন বাড়িঘর।
তজমুল ইউনিয়নের পানিছড়া গ্রামের বাসিন্দা। নিজেকে জমি ব্যবসায়ী বললেও, তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে চড়া সুদে ঋণ দেন। ব্যবসায়ী হলে লাভের ৫০ শতাংশ এবং অন্যদের ক্ষেত্রে লাখে পাঁচ হাজার টাকা করে পরিশোধে চুক্তি করেন। লাভ ও মূল টাকা পরিশোধ করার পরও তজমুল ব্ল্যাংক চেক দিয়ে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা এবং নোটিশ পাঠিয়েছেন।
উপজেলার শিকারখা গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তজম্মুল আলী সম্প্রতি আদালতে তজমুলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তিনি বলেন, ২০২১ সালে মুদি দোকানের জন্য ব্যাংক ঋণের প্রস্তুতি 
নেন। জানতে পেরে ঋণের প্রস্তাব দেন তজমুল হোসেইন। ৩ লাখ টাকা ঋণও দেন। বিপরীতে ব্ল্যাংক চেক ও স্ট্যাম্পে সই নেন। তিনি ৩ লাখ টাকার বিপরীতে ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। চেক ও জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ফেরত না দিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিশে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে ৯ লাখ টাকা ও তাঁর বাবা মনফর আলীকে ৬ লাখ টাকা পরিশোধে নোটিশ প্রদান করেন।
মিনতি রায় জানান, টিয়া হাজির কাছ থেকে এক লাখ টাকা নেন। পরে তা পরিশোধ করেন। সম্প্রতি তাঁকে সাত লাখ টাকার লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। কাপনাকান্দি গ্রামের আরেক ঋণগ্রহীতা আলিম উদ্দিন জানান, আড়াই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তিনি ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। তাঁকে ১৫ লাখ টাকার লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়।
একইভাবে আরেক সরকারি কর্মচারী আয়াত উল্লাহ দেড় লাখ টাকা নিয়ে আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করার পর ৫ লাখ টাকার, রাজু আলী নামের এক ব্যক্তি ২০ হাজার টাকা ধার নিয়ে ১৬ হাজার টাকা পরিশোধের পর ৫ লাখ টাকার লিগ্যাল নোটিশ পেয়েছেন।
তজমুল লোকজনকে ঋণ দিয়ে কৌশলে দাদন ব্যবসার পাশাপাশি প্রতারণা করছেন। প্রভাবশালী হওয়ায় টাকা প্রদানের তাগিদে অনেকে বাড়িঘরে থাকতে পারছেন না। গত বুধবার ৭ ভুক্তভোগী নোটিশ পেয়ে হাজির হন তাঁর বাড়িতে। তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের একটি মামলায় ওইদিন তদন্তে যায় পুলিশ।
জৈন্তাপুর থানার ওসি আবুল বাশার মোহাম্মদ বদরুজ্জামান জানান, তজমুল হোসেনের 
বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা হয়েছে। সেই মামলাটি তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। সুদে টাকা কিংবা লোন দেওয়ার বিষয়টি ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে 
করতে হলে আইনগত সমস্যা রয়েছে। ব্ল্যাংক চেক, স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরসহ অন্য বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
জিম্মাদার বশির আহমদ বলেন, ‘আমাকে সাক্ষী রেখে আত্মীয় কুতুবকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়। আমি একটি চেকও দিই। পরে জানতে পারি আমি জিম্মাদার। মানসম্মানের ভয়ে আমি সেই টাকা পরিশোধ করি। এখন আমাকে ২৫ লাখ টাকার নোটিশ দেওয়া হয়েছে।’
অভিযোগ বিষয়ে তজমুল হোসেইন সমকালকে জানান, তিনি জমি কেনাবেচার ব্যবসায়ী। ব্যবসার জন্য ঋণ দেন। যারা দিতে পারেননি, তাদের উকিল নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। নোটিশের জবাব না দেওয়ায় 
মামলাও করেছেন। সুদের টাকা পরিশোধের পর কেন নোটিশ দিয়েছেন– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ব্যবসার ৫০ ভাগ লাভে টাকা দিয়েছিলাম। সুদে নয়। মোট টাকা হিসাব করে নোটিশ দিয়েছি। আমি কোনো সুদের ব্যবসা করি না।’ যাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তারা বিষয়টি আপস করার চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেন তজমুল।

আরও পড়ুন

×