চাঁদপুরের ইলিশ নিয়ে প্রতারণা: অনলাইনে বিক্রিতে নিতে হবে নিবন্ধন

চাঁদপুরের ইলিশ। ছবি: সমকাল
চাঁদপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫ | ১৮:০১ | আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ | ১৮:০৪
চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে এখনও অনলাইনে ‘চাঁদপুরের ইলিশ’ নামে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা থেমে নেই। জাটকা ইলিশ রক্ষায় ইলিশ ধরা নিষিদ্ধের সময় এই সংঘবদ্ধ চক্রের কাছে কম দামে ‘চাঁদপুরের ইলিশ’ কিনতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন অসংখ্য ক্রেতা। প্রতাকদের কাছে বিকাশ বা অন্য কোনো উপায়ে টাকা পরিশোধ করে শেষ পর্যন্ত ইলিশ মেলেনি। পরবর্তীতে এমন সংবাদ সমকালসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ায় সক্রিয় হয় পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা। সম্প্রতি ঢাকায় ডিবির জালে ধরা পড়ে ৫ প্রতারক সদস্য। এরপর প্রতারকদের তৎপরতা কয়েকদিন থামলেও জুন তথা ইলিশের মওসুমের শুরুর মাসে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে প্রতারক চক্র। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছে এমন সব অভিযোগ আবারও আসতে শুরু করে। এ পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন এবং জেলা পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুর রকিব প্রতারণা ঠেকাতে নতুন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
জেলা প্রশাসন বলছে, চাঁদপুরে এখন থেকে অনলাইনে স্থানীয় ইলিশ বিক্রি করতে নিতে হবে জেলা প্রশাসনের নিবন্ধন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি ‘বিশেষ বিজ্ঞপ্তি’ দেওয়া হয়েছে গত বুধবার।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘চাঁদপুর জেলা সুস্বাদু ইলিশ মাছের জন্যে বিখ্যাত। সেই স্বাদ অক্ষুণ্ন রাখা, ইলিশের মূল্য নিয়ন্ত্রণসহ জেলার মান সমুন্নত রাখার বিষয়ে জেলা প্রশাসন বিভিন্নভাবে প্রতিনিয়ত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে।’
এতে আরও বলা হয়, ‘চাঁদপুর জেলার ইলিশের নাম করে বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ী ভুয়া ফেসবুক পেজ খুলে প্রতিনিয়ত দেশবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে। চাঁদপুর জেলা প্রশাসন এ ধরনের প্রতারণা রোধে ইলিশ মাছের অনলাইন ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।’ ইলিশের অনলাইন ব্যবসার জন্যে আগ্রহী প্রার্থীদেরকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে যোগ্যতা সাপেক্ষে নির্ধারিত ফরম এ আবেদন করতে হবে এবং বর্ণিত কাগজপত্র দাখিল করার মাধ্যমে নিবন্ধন গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, ‘অনলাইনে ইলিশ বিক্রির নামে প্রতারণার অভিযোগ নিয়মিতই আসছে। এর কবল থেকে সাধারণ মানুষ, প্রবাসী, এমনকি প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাও বাদ যাননি। তাই প্রতারণা ঠেকাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, এর সুফল সারাদেশের মানুষ পাবে।’
এদিকে, ‘অনলাইনে চাঁদপুরের ইলিশ ক্রয়ে প্রতারক হতে সাবধান!’- এমন সচেতনতামূলক একটি প্রচার চালিয়েছে পুলিশ সুপার আব্দুর রকিবের তত্ত্বাবধায়নে চাঁদপুর জেলা পুলিশ। সেখানে একটি হটলাইন নম্বর (০১৩২০১১৬৮৯৮) দিয়ে অনলাইন ক্রেতাদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, ‘ইলিশ মাছ কেনার সময় সতর্ক থাকুন, ক্যাশ অব ডেলিভারি পদ্ধতি অর্থাৎ মাছ হাতে পাওয়ার পর টাকা পরিশোধ করুন।’ এছাড়া আরও বলা হয়, ‘ইলিশ মাছের লোভনীয় অফার দেখে প্রতারণার ফাঁদে পা দেবেন না এবং কোনোভাবেই পণ্য পাওয়ার আগে টাকা পাঠাবেন না।’
এদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চাঁদপুর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল ইমরান সমকালকে বলেন, ‘আমাদের কাছে ৪১ জন অনলাইন ব্যবসায়ী এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে, যেগুলো বহু আগে থেকেই চাঁদপুর মৎস্য বিভাগ ও চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ হয়ে আসছে। কিন্তু ইলিশের দাম বৃদ্ধিসহ নানান কারণে অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের ফার্মের নামটা ব্যবহার করে প্রতারক চক্র ভিডিও-অডিও ছাড়ছে বলে জেনেছি। আগে এই অনলাইন ব্যবসায় কখনোই নিবন্ধন সিস্টেম ছিলো না।’ তিনি মনে করেন, ‘এখন জেলা প্রশাসক যেই উদ্যোগ নিয়েছেন, এতে প্রতারণার সুযোগ কম থাকবে।’
‘চাঁদপুর রূপালি ইলিশ’ নামে পেইজবুক পেজের সত্ত্বাধিকারী মুফতী মহীবুল্লাহ সাকী বলেন, ‘আমরা প্রশাসনের তালিকাভুক্ত। ওনাদের কাছে যে ৪১ জনের তালিকা রয়েছে, এর মধ্যে আমারটাও রয়েছে। তবে নিবন্ধন করতে হবে, তা জানি না।’
এ ইলিশ অনলাইন ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমার ফেসবুক পেজও ক্লোন করে প্রতারকরা ব্যবহার করেছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রতারকদের কায়দাটাই অভিনব! নিবন্ধনটা ব্যবসায় নিশ্চয়তা দেবে, কিন্তু যত নিবন্ধন আর তালিকাই করেন, খুব বেশি কাজ হবে না। কাজ হবে ২টা জিনিসে। প্রথমত- মাছ অর্ডার দেওয়ার সময় তাকে ডেলিভারির আগে টাকা না দেওয়া এবং চাঁদপুর মাছ ঘাটে ওই অনলাইন ব্যবসায়ীর সম্পর্কে খবর নেওয়া। আর দ্বিতীয়ত- পুলিশ যদি দ্রুত মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে প্রতারকদের ধরার ব্যবস্থা নয়।’
উল্লেখ্য, চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার সুস্বাদু রূপালি ইলিশের জন্য বিখ্যাত চাঁদপুরকে ২০১৭ সাল থেকেই ‘ইলিশের বাড়ি’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। অবশ্য এর আগ থেকেই যুগ যুগ ধরে চাঁদপুরের ইলিশের খ্যাতি দেশের বাইরে বিদেশেও ছড়িয়ে রয়েছে। এছাড়া জেলার মৎস্য অবতরণকেন্দ্র ‘বড় ষ্টেশন মাছঘাট’ থেকে সবচেয়ে বেশি ইলিশ যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আবার এই ঘাটে বরিশাল, বরগুনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের ইলিশও আসে। তবে চাঁদপুরের ৭০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পদ্মা-মেঘনার ইলিশের বিশেষ রকম স্বাদ থাকায় এর সুযোগ নিয়ে অনলাইনে প্রতারণা চলে।