দেবী বিসর্জনে শেষ হলো সর্বজনীন দুর্গোৎসব

বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসবের সমাপ্তি- সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০১৯ | ০৮:৫৭
শেষ হলো বাঙালির সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মঙ্গলবার চোখের জলে বিদায় দিয়েছেন জগজ্জননী মা দেবী দুর্গাকে। বিসর্জন দিয়েছেন প্রতিমা। সেই সঙ্গে আসছে বছর আবারও এই মর্ত্যলোকে ফিরে আসবেন মা- এই আকুল প্রার্থনাও জানিয়েছেন তারা।
অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ-কল্যাণ ও সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে নিরন্তর শান্তি-সম্প্রীতির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গত শুক্রবার ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে এই উৎসব শুরু হয়েছিল। সনাতন বিশ্বাস ও পঞ্জিকামতে, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার ঘোটকে (ঘোড়া) চড়ে মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) এসেছিলেন (আগমন)। দেবী ঘোটকে চড়েই স্বর্গালোকে বিদায়ও নেন (গমন)।
বিজয়া দশমী উপলক্ষে মঙ্গলবার ছিল সরকারি ছুটি। সকাল সাড়ে ১১টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বঙ্গভবনে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। শান্তি ও মানবতা ধর্মের প্রধান বার্তা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, 'সবাইকে ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী সব ধরনের দুর্নীতি ও অন্যায় আচরণ দূর করার নীতিগতভাবে অঙ্গীকার করতে হবে। ধর্ম অন্যায় কাজ করতে নিষেধ করে।'
বিকেলে রামকৃষ্ণ মিশনে পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করেন এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি বলেন, 'ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। আমাদের উৎসবগুলোতে আমরা সবাই এক হয়ে উদযাপন করি। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের বড় একটা অর্জন।'
প্রতিমা বিসর্জনের আগে দিনব্যাপী নানা পূজা-অর্চনা চলে। সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় দশমীবিহিত পূজা ও দর্পণ বিসর্জন। চলে ভক্তদের আরতি আর রঙের হোলি খেলা। পরম ভক্তি নিয়ে নিজ নিজ মনের বাসনা জানিয়ে দেবীর পায়ে সিঁদুর ছোঁয়ান নারীরা। এরপর বিসর্জনের জন্য সধবা নারীরা দেবীকে সাজান ফুল, সিঁদুর ও নানা অলঙ্কার দিয়ে। পুরোহিতরা দেবীর জন্য সাজান সিদ্ধ চালের নৈবেদ্য, কচুঘেচু, শাপলা দিয়ে। এরপর শেষ মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে বিদায় জানানো হয় দেবীকে।
পাঁচ দিনের শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষ দিনের মূল আকর্ষণ বিজয়া শোভাযাত্রা ও প্রতিমা বিসর্জন। বিকেল ৩টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনের কেন্দ্রীয় পূজামণ্ডপ প্রাঙ্গণ থেকে একযোগে শুরু হয় বর্ণিল শোভাযাত্রা। দুপুর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পূজামণ্ডপ থেকে পূজারিরা ট্রাক ও ঠেলাগাড়িতে করে প্রতিমা নিয়ে সমবেত হন মন্দির মেলাঙ্গনে। সেখানে ভক্তদের নাচ-গানে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। তারা রং ছিটিয়ে ও ঢাকঢোলসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি উলুধ্বনিতে উৎসবমুখর করে তোলেন পরিবেশ।
ঢাকেশ্বরী মন্দির পূজামণ্ডপ থেকে রাজঘট ও নবপত্রিকা (কলা বউ) নিয়ে আসার পর শুরু হয় শোভাযাত্রা। রাজধানীর প্রায় সব পূজামণ্ডপের ভক্তরা সমবেত হন পলাশীর মোড়ে। মূল শোভাযাত্রা শুরু হয় এখান থেকেই। শোভাযাত্রা শুরুর আগে পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত বলেন, 'অশুভ শক্তি বিনাশ করে শুভ শক্তির জয়ের ধ্রুপদী প্রতীক মা দুর্গা। মা দুর্গার কাছে সবার মঙ্গল কামনা করি।'
এরপর মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির নেতাদের নেতৃত্বে শোভাযাত্রায় ট্রাকবাহী প্রতিমাসহ বিচিত্র সাজ-পোশাকে সজ্জিত নারী-পুরুষ, শিশু, কিশোর ও যুবকরা হেঁটে ও বিভিন্ন যানবাহনে চড়ে যোগ দেন। অনেকেই দুর্গা, শিব ও মহিষাসুরসহ পৌরাণিক চরিত্রের নানা সাজে অংশ নেন। যাত্রাপথে রাস্তার দু'পাশে এবং আশপাশের ভবনের ছাদ-বারান্দায় দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ শোভাযাত্রাকে স্বাগত জানান।
এ শোভাযাত্রা ঢাকেশ্বরী থেকে শুরু হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পেরিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দোয়েল চত্বর, জাতীয় প্রেস ক্লাব, মুক্তাঙ্গন, শহীদ নূর হোসেন স্কয়ার, গোলাপ শাহ মাজার, গুলিস্তান হল, নবাবপুর, বাহাদুর শাহ পার্ক ও স্টার সিনেমা হল হয়ে বুড়িগঙ্গার ওয়াইজঘাটে গিয়ে পৌঁছে। সেখানে 'দুর্গা মায় কি জয়', 'আসছে বছর আবার হবে' ধ্বনিতে উৎসবমুখর পরিবেশে প্রতিমা বহনকারী নৌকাগুলো মাঝনদীতে গিয়ে বিসর্জন দেয় মা দুর্গাকে।
হাজারো ভক্ত এ সময় অশ্রুসজল হয়ে পড়েন। বিসর্জনের এই পর্ব চলে রাত অবধি। বিসর্জন শেষে শান্তিজল গ্রহণ এবং ঘরে ঘরে শুভেচ্ছা বিনিময় ও মিষ্টি বিতরণও চলে আনন্দমুখর পরিবেশে।
- বিষয় :
- সর্বজনীন দুর্গোৎসব