ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

শোকের মাস

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তদন্ত কমিশন সময়ের দাবি

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তদন্ত কমিশন সময়ের দাবি

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২১ | ১২:০০

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার সুবেহ্‌ সাদেকের পর যখন মসজিদের মিনার চূড়া থেকে ভেসে আসছিল উদাত্ত আহ্বান- 'আস্‌সালাতু খায়রুম মিনাম নাউম'। মুসল্লিরা ফজরের নামাজের জন্য মসজিদের দিকে এগোতে থাকেন। ঠিক তখন ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও রমনা এলাকার সাধারণ মানুষ গুলির শব্দে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। মুসল্লিরা হতচকিত ও ভীত হয়ে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকেন। তারা কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কী হলো? কিছুক্ষণ পর রেডিওতে সম্প্রচারিত মেজর ডালিমের ঘোষণায় দেশবাসী চমকে ওঠে, হতবাক হয়। জানতে পারে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। নির্বাক, বিস্মিত, বেদনার্ত হয় জাতি। অনেকেই এই ঘোষণা বিশ্বাস করতে পারছিল না। বেতারে কিছুক্ষণ পরপর ঘাতক মেজর ডালিমের একই ঘোষণা সম্প্রচারিত হচ্ছিল। সেদিনের এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্বও হয়েছিল বেদনার্ত-হতবাক।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কময় নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারাদেশে বিক্ষিপ্ত কিছু প্রতিবাদ হলেও কেন্দ্রীয়ভাবে বড় কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। মানুষ ছিল স্তম্ভিত-বাকহীন। বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এবং বিকেল বেলা ২১ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য ও ওই কালরাতে যারা নিহত হয়েছিলেন, তাদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ঘাতকদের বিচার না করে পুরস্কৃত করা হয়েছিল, যা সভ্য বিশ্বে নজিরবিহীন। সেই সঙ্গে বিচারহীনতার এই গ্লানি ছিল জাতির জন্য চরম এক আঘাত।
এরপর ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে ঘাতকরা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। ৭ নভেম্বর আরেক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার আবারও পটপরিবর্তন হয়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এএসএম সায়েম। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান উপসামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
কিছুদিন পর ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রায় সব ঘাতককেই বিদেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনে চাকরি প্রদান করেন। এভাবে আত্মস্বীকৃত ঘাতকদের বিদেশি মিশনে চাকরি প্রদান প্রকারান্তরে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান এর যে সজ্ঞান সমর্থন ছিল তাই প্রমাণ করে। আমরা দেখেছি ঘাতকরা ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সামরিক ও স্বৈরশাসন আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ আনুকূল্য ভোগ করেছে।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এএফএম মুহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা করেন। মামলার তদন্তকাজ শেষে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক আদালতে উত্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ঢাকার বিজ্ঞ দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ০৮.১১.১৯৯৮ তারিখে এক রায় ও আদেশে ১৯ জন অভিযুক্তের মধ্যে ১৫ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে সাবাইকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। পরবর্তীতে বিচারিক আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করলে হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চ শুনানি গ্রহণ করেন এবং বিচারকার্য শেষে ১০ জন অভিযুক্তের ব্যাপারে বেঞ্চের উভয় বিচারক একমত পোষণ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। আর পাঁচজন অভিযুক্তকে বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলেও জ্যেষ্ঠ বিচারক মো. রুহুল আমিন তার সঙ্গে একমত পোষণ করেননি। ফলে মামলাটি মাননীয় প্রধান বিচারপতি কর্তৃক তৃতীয় বেঞ্চে পাঠানো হয়। তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি ফজলুল করিম এবিএম খায়রুল হক কর্তৃক যে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্য থেকে দু'জনের দণ্ডাদেশের ব্যাপারে বিচারপতি খায়রুল হকের মতের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। অর্থাৎ, মোট ১৫ জন অভিযুক্তের মধ্যে হাইকোর্ট কর্তৃক ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয় এবং অপর তিনজনকে খালাস প্রদান করা হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পাঁচজন আপিল বিভাগে লিভ পিটিশন দাখিল করেন। লিভ মঞ্জুর করা হলো। চূড়ান্ত বিচারে তাদের আপিল খারিজ হয় এবং কারাগারে থাকা দণ্ডপ্রাপ্তদের দণ্ড পরবর্তীতে কার্যকর হয়।
বিচারহীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে জাতি ও মানবতা স্বস্তি পায়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরও অনেক প্রশ্ন সামনে আসে এবং এখনও আসছে। যারা বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন, এরা সবাই সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন। প্রশ্ন হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বিশ্বনন্দিত একজন রাষ্ট্রনায়ক ও স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশের রূপকার এবং তার পরিবারের সদস্যদের কী কেবল কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যের সিদ্ধান্তের আলোকেই হত্যা করা হয়েছিল নাকি এর পেছনে ছিল কোনো ষড়যন্ত্র। সম্প্রতি বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের লেখা 'বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা- সেনাবিদ্রোহ নয় পরিকল্পিত খুন' (১২ আগস্ট ২০২১ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছে) শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। আপিল বিভাগ প্রদত্ত রায়ে তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, "অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে একটা বেআইনি কাজ করতে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির 'মতৈক্য'। মতৈক্য অনুসারে বেআইনি কাজটি হতেও পারে, নাও হতে পারে। তার পরও ওই রূপ মতৈক্যটাই হলো অপরাধ এবং তা শাস্তিযোগ্য। কোনো বেআইনি কাজ কিংবা বেআইনি নয় এমন কাজ বেআইনি পন্থায় করা বা করার কারণ ঘটানোর জন্য দুই বা ততোধিক ব্যক্তির স্রেফ একমত হওয়াটাই হলো 'অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র'। ষড়যন্ত্রে সহযোগিতাকারীকে অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তির সঙ্গে অপরাধ সংঘটন কর্মে শারীরিক বা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই, ষড়যন্ত্র অনুযায়ী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং এই অপরাধ সংঘটনে সে যে কোনো পর্যায়ে লিপ্ত থাকলে সেটাই তাকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র যেহেতু গোপনে রচিত হয়, সেহেতু এর প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য থাকে না। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র প্রমাণে পারিপার্শ্বিক ও অবস্থাগত সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করতে হয় ...।"
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল, সেটির সূত্রপাত ১৫ আগস্টেই হয়েছিল এ কথা মনে করলে ভুল করা হবে। এর মূল বা শিকড় প্রোথিত হয়েছে অনেক আগেই। সামরিক-বেসামরিক কিছু কুশীলবের ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে এই নির্মম নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সরকারের প্রথম দিকে খন্দকার মোশতাককে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার কার্যকলাপ তৎকালীন মুজিব নগর সরকারের কাছে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তাকে মন্ত্রিসভায় রাখা হলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যকলাপ থেকে অনেকটা বিরত রাখা হয়। তখন থেকেই খন্দকার মোশতাক তৎকালীন মার্কিন সরকারের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসা যায় কিনা তার চেষ্টা করছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ধূর্ত মোশতাক বঙ্গবন্ধুর উদারতার সুযোগে তার সরকারে ঠাই করে নিতে পেরেছিলেন। ১৯৭২ সাল, দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু প্রশাসনের সর্বস্তরে পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। একটি ভগ্ন স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানপন্থি যেসব চাকরিজীবীরা যুদ্ধকালীন ৯ মাস পাকিস্তান সরকারের স্বার্থ রক্ষা করে কাজ করেছেন, তাদের সবাইকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ রকম একটি অবস্থায় সামরিক -বেসামরিক চাকরিজীবীদের অনেকেই তাদের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকা পাকিস্তানপন্থি রাজনৈতিক চেতনাপ্রসূত কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকে। তারা গোপনে যোগাযোগ রাখতে থাকে খন্দকার মোশতাকসহ আরও কিছু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে, যারা সেদিন বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতার সুযোগে তার খুব কাছে যেতে পেরেছিল। ওই লোকগুলো কারা? যারা একদিন বঙ্গবন্ধুর সামান্য সহানুভূতি পাওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে থাকত, তারাই অতঃপর সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য হয়ে উঠেছিল অস্থির। এ ষড়যন্ত্রের অন্যতম হোতা ছিল খন্দকার মোশতাক আহমেদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কেএম ওবায়দুর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুরের মতো বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের আস্থাভাজন রাজনৈতিক নেতারা (সূত্র :বেইমানির ইতিবৃত্ত, মানিক মো. রাজ্জাক, পৃষ্ঠা ৪১)। উল্লেখিত এ চারজন ছাড়াও খন্দকার মোশতাকের অসাংবিধানিক শাসনামলে মন্ত্রিত্বের আসনে আসীন হয়ে মোশতাকের অবৈধ কার্যকলাপকে সহায়তা দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় যারা ১৫ আগস্ট সকাল পর্যন্ত কাজ করেছেন তাদের মধ্যে অন্তত পক্ষে ২০ জন সদস্য। এই ২০ সদস্যের মধ্যে পরবর্তীতে কেউ কেউ আওয়ামী লীগের মূলধারায় ফিরে এলেও প্রকাশ্যে তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছেন বা ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এমনটি কখনও শোনা যায়নি। আবার অনেকেই জিয়া-এরশাদের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক সংগঠনে যোগদান করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের অন্যতম নায়ক সৈয়দ ফারুক রহমান প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিল, 'শেখ মুজিব তাদের কার্যক্রমের বলি হয়েছেন যারা তাঁর আজীবনের রাজনীতির সুবিধাভোগী ছিলেন।' কথাটি একজন ঘাতকের মুখের হলেও তাকে অসত্য বলা যাবে না। তাকে অসত্য বললে ভুল হবে। যারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন, তাদের দেখা গেল ১৫ আগস্ট বিকেল বেলা খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় সহাস্যে শপথ নিচ্ছেন। অন্যদিকে আরেকটি চিত্র দেশবাসী বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছেন। সেটি হলো, ১৫ আগস্টের পর জাতীয় চার নেতাসহ বহু রাজনৈতিক নেতাকে কারান্তরালে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। কারণ তারা খন্দকার মোশতাকের সরকারকে সমর্থন করতে পারেননি। মিজানুর রহমান খানের লিখিত বই 'মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড'-এ উলেল্গ্লখ করা হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার উৎখাত করতে মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৭৪ সালের ১৩ মে সন্ধ্যায় 'উচ্চতম পর্যায়ের বাংলাদেশ সেনা কর্মকর্তার নির্দেশে' মার্কিন প্রশাসনের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করেছিল। ১৯৭৪ সালে ফারুকের অভ্যুত্থান ঘটানোর এই অশুভ আগ্রহ প্রকাশের বিষয়টি ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরকে ২১৫৮ নম্বর গোপন তার বার্তার মাধ্যমে ১৯৭৪ সালের ১৫ মে অবহিত করেছিলেন। (পৃষ্ঠা ৪৮) সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎকার প্রদানকালে সৈয়দ ফারুক রহমান বলেছিল, 'জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টস্থ বাসভবনের চত্বরে বসে প্রস্তাব দেওয়ার পর তিনি আমাকে উৎসাহিত করলেন কিন্তু সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন না ...। ' (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৩৩০)
প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলজ কর্নেল আবু তাহের হত্যা মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চে ১৪ মার্চ ২০১১ তারিখে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। তিনি আদালত কক্ষে বলেছিলেন, 'শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।' লিফসুলজ আরও বলেছিলেন, 'জিয়া আগস্ট অভ্যুত্থানের খেলোয়াড়দের অন্যতম। তিনি চাইলে অভ্যুত্থান হয়তো বন্ধ করতে পারতেন। কারণ, এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তিনি আগেই ওয়াকিবহাল ছিলেন।' (সূত্র : মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড, মিজানুর রহমান খান, পৃষ্ঠা ৪৯-৫০)। ২০০৫ সালে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে লিফসুলজ লিখেছিলেন, 'মেজর রশিদ এক বৈঠকে প্রশ্ন তুললেন, অভ্যুত্থানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব কী হবে? জিয়া ও মোশতাক উভয়ই আলাদাভাবে বললেন, তারা এ বিষয়ে মার্কিনিদের মনোভাব জেনেছেন। দু'জনের উত্তর একই রকম ছিল। তারা বললেন, এটা (মুজিবকে সরানো) মার্কিনিদের জন্য কোনো সমস্যা নয়। আমি তখন অনুভব করলাম মার্কিনিদের সঙ্গে জিয়া ও মোশতাকের আলাদা যোগাযোগের চ্যানেল রয়েছে।' (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৫০)

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের চেষ্টা ছিল প্রবল। ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারত ও সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ঢাকায় ছিলেন না। ভারতের হাইকমিশনার সমর সেন গাড়িতে চেপে কলকাতা হয়ে ১৬ আগস্ট ঢাকায় পৌঁছান। তিনি হাইকমিশনে তার সহকর্মী এবং ঢাকার বন্ধুদের সঙ্গে অনেকগুলো বৈঠক সেরে ১৮ আগস্ট বঙ্গভবনে মোশতাকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর সমর সেন তার হাতে থাকা একখণ্ড কাগজে যা লেখা ছিল তা পড়ে শোনানোর পর খন্দকার মোশতাক বিমর্ষ চেহারায় ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন। এতে লেখা ছিল, 'যদি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করা হয় এবং কোনো দেশের সঙ্গে কনফেডারেশন করা হয়, তাহলে ভারতের কাছে থাকা বৈধ চুক্তির আওতায় ভারতের সেনাবাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু আপনি যদি নাম পরিবর্তন এবং তথাকথিত কনফেডারেশনের ধারণা থেকে বিরত থাকেন, তাহলে ভারত ১৫ আগস্ট থেকে যা-ই ঘটুক না কেন, তাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করবে।' (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ১১০) উল্ল্লেখিত কথাগুলো থেকে তখনকার ভারত সরকারের মনোভাব যেমন প্রকাশ পায়, ঠিক তেমনি আরেকটি বিষয় অনুধাবন করার মতো সেটি হলো, সেদিন যদি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য উপস্থাপন করা না হতো, তাহলে হয়তো বাংলাদেশ নামক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রটির রাজনৈতিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়ে যেত।
১৯৭৫ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন বাইরোড। তিনি তার সরকারের কাছে প্রেরিত এক তার বার্তায় উল্ল্লেখ করেছেন, ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তন ও খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা দখলকে জামায়াতে ইসলামীর আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা মওদুদী 'আল্ল্লাহর আশীর্বাদ' ও 'ইসলামের বিজয়' হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ১১৪)
১৫ আগস্টের কুশীলবরা সেদিন বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হেনেছিল চরমভাবে। বাংলাদেশ বেতার রাতারাতি হয়ে উঠল রেডিও বাংলাদেশ। কৌশলে রেডিও বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথের গান বর্জন করেছিল। সাময়িকভাবে গীতা পাঠও বন্ধ হয়েছিল। যে কোনো অনুষ্ঠান শেষে 'জয় বাংলা' উচ্চারণের পরিবর্তে তারা 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' স্লোগানটির প্রচলন করে। তবে গীতা পাঠ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান তারা বেশিদিন বন্ধ রাখতে পারেনি। কিন্তু 'রেডিও বাংলাদেশ' ও 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' এই শব্দগুলোর ব্যবহার সরকারিভাবে ১৯৯৬ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বহাল ছিল।
উপরের তথ্যভিত্তিক আলোচনা থেকে এই ধারণা পাওয়া যায়, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিছক কোনো সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের প্রয়াস ছিল না। এটি ছিল বাঙালি রাষ্ট্রসত্তার মূলে কুঠারাঘাত ও এই জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠাতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার এক ঘৃণ্য প্রয়াস, যে পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র হয়তোবা লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটনা-পূর্ববর্তী দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছিল।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ষড়যন্ত্র কখনও বাস্তবায়িত হতে পারে না যার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয় তার কাছের মানুষের সহযোগিতা ছাড়া। এই হীন প্রকৃতির মানুষরাই যুগ যুগ ধরে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে আসছে। ভাবাদর্শগত মতাদর্শগত, আর্থিক স্বার্থ চরিতার্থ করণ, ঈর্ষাপরায়নতাসহ বিভিন্ন কারণে এই তথাকথিত কাছের মানুষরাই বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে। এই রকম বিশ্বাসঘাতকদের একজনের নাম মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস। রোমান সম্রাট সিজারের দয়ায় বেঁচে যাওয়া এবং তার সরকারের উচ্চ পদে পদায়িত এই ব্রুটাস সিজারবিরোধী ষড়যন্ত্রে ও হত্যায় লিপ্ত ছিল। ব্রুটাস নিজেই সিজারের ওপর ছুরি চালিয়েছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। মৃত্যুর আগে ব্রুটাসের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সম্রাট সিজার বলেছিলেন, 'ইউ ট্যু ব্রুটাস।'
বাংলার শেষ নবাব সিরাজুদ্দৌল্লার নিকটাত্মীয় ছিলেন তার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান। লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে গোপন আঁতাতের ভিত্তিতে ঈর্ষা-বিদ্বেষ- লোভের বশবর্তী হয়ে পুত্রতুল্য নবাব সিরাজকে শুধু যুদ্ধে পরাজিত করিয়েই মীর জাফর আলী খান ক্ষান্ত থাকেননি, মোহাম্মদী বেগকে দিয়ে বন্দি নবাবকে হত্যাও করিয়েছিল এই বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর আলী খান। এই বিশ্বাসঘাতক তার জীবদ্দশায় কখনও তার পাপাচারের জন্য অনুশোচনা প্রকাশের প্রয়োজন মনে করেনি।
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কখনও কোনো বিষয়ে খন্দকার মোশতাক দ্বিমত করেছেন এর খুব একটা প্রমাণ পাওয়া যায় না। এভাবেই মোশতাক বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ততা অর্জন করেছিল। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ভোরে শেরোয়ানি পরে পায়চারি করছিল খন্দকার মোশতাক, বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার খবর পাওয়ার আশায়। ইতিহাসে ব্রুটাস, মীর জাফর আলী খান ও আরও বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে নতুন যে নামটি সংযোজিত হলো, সেটি হলো খন্দকার মোশতাক আহমেদ। বাংলাদেশে সম্ভবত ১৯৭৫ এর পর নবজন্ম নেওয়া কোনো শিশুর নাম সচেতনভাবে কেউ 'মোশতাক' রাখেন না। এ যেন বিশ্বাসঘাতকের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের নামান্তর।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যেসব আওয়ামী লীগ নেতা যোগ দিয়েছিলেন, তারা সবাই আগের দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। খন্দকার মোশতাক ২১ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভায় ১০ জনকে দিয়েছিলেন পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা আর ১১ জনকে দিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা। মোশতাক সরকারের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ১০ জন এবং স্পিকার ও হুইপ হিসেবে কর্মরত আরও দু'জনসহ মোট ১২ জন অবশ্য পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের ২৫ আগস্ট এক বর্ধিত সভায় যোগদান করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধুর সরকারে ছিলেন এ রকম তিন-চারজন যারা পরবর্তীতে মোশতাক মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছিলেন তারা আর আওয়ামী লীগে ফিরে আসেননি। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, কেএম ওবায়দুর রহমান এই চারজনকে বঙ্গবন্ধুবিরোধী ষড়যন্ত্রের সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে কাজ করেছেন বলে অনেকেই মনে করেন। (এবং মোশতাকের মন্ত্রিসভার বেইমানির ইতিবৃত্ত :মানিক মো. রাজ্জাক পৃষ্ঠা ৪১-৪৪)
মোশতাক মন্ত্রিসভা থেকে ফিরে এসে যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হলেন বা যারা ফিরে আসেননি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তাদের মধ্যে কেউ জড়িত ছিলেন কিনা এ বিষয়টি আজও জাতির সামনে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণপত্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা পায়নি। উল্ল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ নিজেরাও কখনও পরিস্কার করেননি তাদের তখনকার অবস্থান। শুধু উপরোল্ল্লেখিত চারজন যথাক্রমে- শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও কেএম ওবায়দুর রহমান গংয়ের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা না পাওয়া গেলেও হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তারা জড়িত ছিলেন- এ বিষয়টি বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত। তবে আরও অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে এদেরসহ অন্য সবার সম্পৃক্ততার প্রকৃতি ও পরিধি সুনির্দিষ্ট হওয়া উচিত।
লরেন্স লিফসুলজের আদালতে প্রদত্ত বক্তব্য মতে এবং কর্নেল ফারুক-রশিদের বক্তব্য থেকে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তৎকালীন সেনা উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের পরোক্ষ সম্পৃক্ততা পরিলক্ষিত হয়। এটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে, শুধু অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এত বড় একটি ঘটনা সংঘটিত করতে সক্ষম হয়েছিল। এর পেছনে যেমন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিল, ঠিক তেমনিভাবে দেশীয় সামরিক-বেসামরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের ওই ষড়যন্ত্রে সম্পৃক্ত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার মহীয়সী স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে দেশের প্রচলিত আইনে। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছিল। তিনি দেশের প্রচলিত আদালতে অন্যান্য বিচারপ্রার্থী যেভাবে বিচার প্রার্থনা করেন, ঠিক তেমনিভাবেই বিচার প্রার্থনা করেছিলেন। যদিও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হলেও এ ব্যাপারে কেউ আপত্তি করত না।
বিচারকার্য শেষে বেশ ক'জন দণ্ডিত ঘাতকের সাজা কার্যকর হয়েছে। দণ্ডিতদের বেশ ক'জন এখনও দেশের বাইরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কেন, কেন সেদিন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল? এর পেছনে কী ধরনের ষড়যন্ত্র কাজ করেছিল, দণ্ডিত অভিযুক্তরা ছাড়া আর কারাইবা এই অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এবং কীভাবে ছিল এটা জানা জাতির অধিকার। আপিল বিভাগের রায়ে উঠে এসেছে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের বিষয়টি। উঠে এসেছে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে একমত হয়ে যুক্ত কেউ সেই ষড়যন্ত্র সাধনকল্পে হত্যাকাণ্ডের মূল ঘটনায় যুক্ত না থাকলেও সেও মূল অপরাধের জন্য সমভাবে দোষী। কারও প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে নয়, বরং ঘটনার পেছনের ষড়যন্ত্রের সত্যটি জাতির সামনে তুলে ধরার জন্যই সরকারের উচিত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের পেছনের ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা। সেই লক্ষ্যে একটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা। সরকার কমিশনের নিরপেক্ষতার কথা মাথায় রেখে এই কমিশন কীভাবে সাজাবে, এটি তারাই নির্ধারণ করতে পারে। এটি সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি, গবেষক, সাবেক সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিবর্গকে নিয়েও গঠিত হতে পারে অথবা শুধু উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনও হতে পারে।
১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সেদিন কেবল বাঙালি জাতিকে নয়, এই নির্মমতা বিশ্বের বিবেকবান জনগোষ্ঠীকেও কাঁদিয়েছে। হতবাক হয়েছে মানবতা। বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ উৎসারিত দর্শন ও কর্ম চিরকাল আমাদের জন্য এক অগ্রণী ভূমিকা রেখে যাবে। এই শোকাবাহ আগস্টে স্মরণ করছি জাতির পিতা নির্ভীক বঙ্গবন্ধুর গভীর দেশপ্রেমকে যা তাকে গণমানুষের কাছে নিয়ে এসেছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ একটি মহাকাব্য যার রূপকার বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও আদর্শে সদা মূর্ত রয়েছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও প্রেরণা। মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের মাঝেই তিনি নিজেকে খুঁজে পেতেন। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুুর শিক্ষা ও গণকল্যাণমুখী দর্শন বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের আড়ালে থাকা সত্যকে সামনে আনতেই হবে। বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে আছেন এবং থাকবেন চিরকাল। তিনি অমর অক্ষয়। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী।
দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সরকারের প্রতি আহ্বান- অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্ত কমিশন গঠন করে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের পেছনে সম্পৃক্ত সব ষড়যন্ত্রকারীর পরিচয় জাতির সামনে উন্মোচন করার জোর দাবি জানাচ্ছি।

বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ, ঢাকা

আরও পড়ুন

×