বিশ্ব রক্তদাতা দিবস
জীবন বাঁচানোর যৌথ যাত্রা

প্রতীকী ছবি
গোলাম কিবরিয়া
প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৫ | ০১:১১ | আপডেট: ১৫ জুন ২০২৫ | ১৮:০২
প্রথমবার বন্ধুদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় রক্তদানের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন রাহিল। বয়স তখনও ১৮ হয়নি। সন্ধানীর স্বেচ্ছাসেবীরা তখন বলেছিলেন– ‘১৮ বছর পূর্ণ হলে এসো, জীবন বাঁচাতে রক্ত দিও।’ রাহিল সে কথার মান রেখেছেন। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর নিয়মিত রক্ত দিয়ে চলেছেন, এখন পর্যন্ত ৩৯ বার! তিনি বলেন, ‘মানুষের উপকার করতে পারার আনন্দের সঙ্গে আর কিছু তুলনা হয় না। এই ভাবনা থেকেই রক্তদানের চিন্তা মাথায় আসে।’
১৪ জুন, বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। ২০০৪ সাল থেকে এ দিনটি উদযাপিত হয়ে আসছে, বিশ্বব্যাপী রক্তদাতাদের নিঃস্বার্থ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে– ‘দাও রক্ত, জাগাও আশা– জীবন বাঁচানোর যৌথ যাত্রা’। প্রতিপাদ্যটিই যেন বলে দেয়, একাই নয়– এই পথচলা একসঙ্গে, জীবনের পাশে দাঁড়ানোর যাত্রা।
বাংলাদেশেও স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার প্রবণতা আশাব্যঞ্জকভাবে বাড়ছে। পেশাদার ডোনারদের তুলনায় এখন স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা বেশি। জীবন বাঁচানোর যৌথ যাত্রায় কাজ করে যাচ্ছেন দেশের বহু মানুষ। কেউ এককভাবে, কেউ সংগঠনের ব্যানারে কাজ করছেন এই মানবিক প্রয়াসে। তেমনই একটি সংগঠন ‘ব্লাডম্যান বাংলাদেশ’। নামটি শুনে সুপারহিরোর কথা মনে হতে পারে, তবে তারা বাস্তবের নায়ক। এটি একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যারা রক্তদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। এদের একটি কল সেন্টার রয়েছে– ০১৬২৭-২৬০৯৩৩; যার মাধ্যমে প্রতিদিন কেউ না কেউ ফিরে পান বেঁচে থাকার সুযোগ।
ব্লাডম্যানের প্রতিষ্ঠাতা শাহারিয়ার হাসান জিসান বলেন, ‘দেশে রক্তের যে চাহিদা, তা পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে না। স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় কম। ফলে রক্তের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আরও বেশি মানুষকে এই দায়িত্ব নিতে হবে।’
থ্যালাসেমিয়া রোগী মো. মারুফ বিল্লাহ ২০০৮ সাল থেকে রক্ত নিচ্ছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা বেদনাবিধুর– ‘যখন আমার শরীরে রক্ত কমে যায়, তখন বিভিন্ন রকম অসুস্থতার মধ্যে পড়ে যাই। হাত-পা প্রচণ্ড ব্যথা করে। দাঁড়াতে অসুবিধা হয়, মাথা ঘোরে। কোনো কাজ না করা সত্ত্বেও হাঁপাতে থাকি। এ সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে যখন রক্ত পাই না। একবার রক্ত না পেয়ে খুব কষ্টের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম আমি ও আমার পরিবার। অনেক খোঁজার পরও আমার গ্রুপের রক্ত পাচ্ছিলাম না। আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। শেষমেশ এক আত্মীয় এসে রক্ষা করেছিলেন আমাকে। আরেকবার আমি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখনও প্রায় ১০ দিন পর একজন ডোনারের সন্ধান পেলাম। তাঁর হাসপাতালে আসার কথা ছিল। আমি পৌঁছাতে একটু দেরি করে ফেলেছিলাম। কারণ সেদিন কোনো যানবাহন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। দেরি হওয়ার জন্য আমি ক্ষমা চাইলাম। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, তাচ্ছিল্য করেন। আমি অসহায় ছিলাম। তারপরেও রক্ত মেলেনি। ডোনারের সঙ্গে আমার রক্ত ম্যাচ করল না। ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয় সেসব মুহূর্ত।’
করোনাকালেও এ রকম অসংখ্য মানবিক গল্প জন্ম নিয়েছে। এমনই এক অভিজ্ঞতার কথা জানান রাতুল হাসান। তাঁর মায়ের জরুরি অস্ত্রোপচারে দরকার ছিল দুই ব্যাগ রক্ত। সংক্রমণের ভয়, লকডাউন– সবকিছুর মাঝে এগিয়ে এসেছিলেন দু’জন অচেনা রক্তদাতা। রাতুল বলেন, ‘ওই সাহায্যের কথা আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না।’
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নওশাদ। আদরের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া থাকায় প্রায় প্রতি মাসেই এক বা একাধিকবার রক্তের প্রয়োজন হয়। নওশাদ বলেন, ‘প্রতি মাসে যাদের রক্তের প্রয়োজন শুধু তারা ও তাদের পরিবারই জানে কী কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় আমাদের। জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসা সব রক্তদাতার প্রতি আমাদের চিরকৃতজ্ঞতা।’
রক্তদানের আনন্দ শুধু গ্রহীতার বাঁচিয়ে তোলাতেই সীমাবদ্ধ নয়, দাতার নিজের মধ্যেও তা জন্ম দেয় অপার শান্তি। রক্তগ্রহীতা আর তাঁর পরিবার কৃতজ্ঞ থাকেন জীবন বাঁচানোর জন্য। অন্যদিকে দাতার জন্য এটি যে কী আনন্দের, তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। আবার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণেও রক্ত দেওয়া অত্যন্ত পুণ্য বা সওয়াবের কাজ। তেমনি শারীরিক দিক থেকেও এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, নিয়মিত রক্ত দেওয়া শরীরকে রাখে সুস্থ ও সচল, নতুন রক্তকোষ গঠনে সাহায্য করে।
মানবিক ও ধর্মীয় সব দৃষ্টিকোণ থেকে রক্তদাতা অনাবিল শান্তি অনুভব করেন এবং সামাজিকভাবে বিশেষ মর্যাদা পান। বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে দৃঢ় সম্পর্ক হলো রক্তের সম্পর্ক– গভীর, অচ্ছেদ্য বন্ধন। রক্তদানের মাধ্যমে গড়ে ওঠে মানবিকতার সম্পর্ক, গড়ে ওঠে সমাজে সংহতি ও সহমর্মিতার সেতু। রক্ত চেনে না জাতি, বর্ণ, গোত্র কিংবা ধর্ম– এ এক নীরব ভালোবাসার বার্তা। এই নিঃস্বার্থ সম্পর্কগুলোই সমাজকে করে তোলে আরও মানবিক, আরও সংবেদনশীল।
ভূপেন হাজারিকার অমর গানের পঙ্ক্তি মনে পড়ে– ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য।’ এই কথাগুলোর জীবন্ত উদাহরণ আজকের স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতারা। তাদের ভালোবাসা, তাদের নিঃস্বার্থতা আমাদের জীবনযাত্রাকে করে তোলে আরও আলোকিত। রক্তদানের মতো ছোট্ট এক কর্ম, কখনও হয়ে ওঠে কারও জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার।