ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

বৃত্তের ধ্রুবক নিয়ে অন্যরকম লড়াই

বৃত্তের ধ্রুবক নিয়ে অন্যরকম লড়াই

.

 শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫ | ০০:১৫ | আপডেট: ২৮ জুন ২০২৫ | ১৩:১৪

একটি বৃত্তের পরিধিকে তার ব্যাস দিয়ে ভাগ করলে যে মান পাওয়া যায়, সেটিই π (পাই)। যুগ যুগ ধরে এই ধ্রুবকটি গণিতচর্চার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে– এই ধ্রুবক কি আদৌ ঠিক ছিল? অনেক গণিতবিদ বলেন, আদতে ধ্রুবকটি হওয়া উচিত τ (টাউ), মানে ২π। এ নিয়ে শুধু গণিতের পাঠশালায় নয়– চলছে উৎসব, বিতর্ক, এমনকি গড়ে উঠেছে নতুন ধরনের গণিতপ্রেমী সংস্কৃতি।

পাই দিবস: একটি সংখ্যার জন্মোৎসব
গল্পটা শুরু ১৯৮৮ সালে। সান ফ্রান্সিসকোর এক বিজ্ঞান জাদুঘরে কাজ করতেন পদার্থবিদ ল্যারি শ। ১৪ মার্চ, মানে ৩/১৪; যা মিলে যায় π-এর প্রথম তিন অঙ্কের সঙ্গে–সেই দিনে তিনি সহকর্মীদের নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন একটি বৃত্তাকার করিডোরে। পরে সবাই মিলে খেলেন ফলের পাই। সেখান থেকেই জন্ম নেয় পাই দিবস। এই ছোট আয়োজন ক্রমে পরিণত হয় আন্তর্জাতিক উৎসবে। ২০০৯ সালে মার্কিন কংগ্রেস ১৪ মার্চকে ঘোষণা করে ন্যাশনাল পাই ডে। ইউনেস্কো ২০১৯ সালে এই দিনটিকে ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক গণিত দিবস।

পাই দিবস ঘিরে আছে সংখ্যা নিয়ে খেলার মজা। ২০১৫ সালের ১৪ মার্চ, সকাল ৯টা ২৬ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে মুহূর্তটিকে বলা হয় ‘পাই ইনস্ট্যান্ট’। কারণ এই সময়টিতে মিলে যায় π-এর প্রথম ১০টি অঙ্ক– ৩.১৪১৫৯২৬৫৩। উদযাপন শুধু সংখ্যা নিয়ে খেলা নয়; যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটি প্রতিবছর এই দিনে তাদের ভর্তি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে কখনও সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে, আবার কখনও ৬টা ২৮ মিনিটে; যা আবার τ (টাউ)-এর প্রতীকী সময়।

টাউ দিবস: যুক্তির ভাষায় একটি বৃত্ত
π-এর বদলে τ ব্যবহারে গণিত আরও সহজ হবে– এমন দাবি বহুদিন ধরেই রয়েছে। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বব পালাইস নামে এক গণিতবিদ প্রকাশ করেন এক প্রবন্ধ ‘পাই ইজ রং!’ এরপর ২০১০ সালে লেখক ও শিক্ষাবিদ মাইকেল হার্টল প্রকাশ করেন ওয়েবসাইট ‘দ্য টাউ ম্যানিফেস্টো’। সেখানেই উঠে আসে, বৃত্তের পরিধিকে ব্যাসার্ধ দিয়ে ভাগ করলে যে সংখ্যা পাওয়া যায়, সেটিই হওয়া উচিত প্রকৃত ধ্রুবক– τ = ২π = ৬.২৮৩১৮...

এই যুক্তিকে সামনে রেখে প্রতি বছর ২৮ জুন (৬/২৮) উদযাপিত হয় টাউ দিবস। এই দিনে গুগলের ক্যালকুলেটরে দেখা যায় τ, আর প্রোগ্রামিং ভাষা– পাইথন, জাভা, রাস্ট এমনকি মাইক্রোসফটের ডটনেটেও τ-এর জন্য রয়েছে আলাদা জায়গা।

গণিত মানে শুধু সংখ্যা নয়, সংস্কৃতিও
π-কে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক বিস্তৃত গণিত সংস্কৃতি। কোথাও পাই খাওয়ার প্রতিযোগিতা, কোথাও আবার π মুখস্থ করার আয়োজন। আইনস্টাইনের জন্মদিনও এই দিনেই হওয়ায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে হয় আইনস্টাইনসদৃশ প্রতিযোগিতা।

২০২৪ সালে গণিতপ্রেমী ম্যাট পারকার ও লন্ডনের সিটি অব লন্ডন স্কুলের শিক্ষার্থীরা হাতে লিখে নির্ণয় করেন π-এর ১৩৯টি অঙ্ক। শতাব্দীতে এটিই ছিল সবচেয়ে বড়হাতে লেখা গণনা। এই অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২৪ সালের আগস্টে একটি গ্রহাণুর নাম রাখা হয় তাঁর নামে– ৩১৪১৫৯ ম্যাট পারকার। সংখ্যাটি খেয়াল করলে বোঝা যায়, এটি π-এর প্রথম ছয় অঙ্ক।

অন্যদিকে, τ নিয়ে গড়ে উঠছে নতুন প্রজন্মের ম্যাথ মুভমেন্ট; যারা চায় সরলীকরণ, তারা π-এর বদলে τ-কে আপন করে নিচ্ছে। দ্য টাউ ম্যানিফেস্টো ইতোমধ্যে অনূদিত হয়েছে আটটি ভাষায়।

তাহলে কি পাই সত্যিই ভুল?
π গণিতের ভাষায় এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে একে বাদ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। আবার অনেকে মনে করেন, শিক্ষার্থীদের জন্য এটি অপ্রয়োজনীয় জটিলতা তৈরি করে। কারণ গণিতে কোণ মাপা হয় র‍্যাডিয়ান এককে এবং π মানে হচ্ছে অর্ধবৃত্তের র‍্যাডিয়ান সংখ্যা। ফলে, অনেক সময়ই শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হয়।

ধরুন, একটি পিৎজার অষ্টমাংশ টুকরো, তাতে কোণ হওয়া উচিত π/৮, তাই না? না, আসলে সেটি হয় π/৪। কারণ π মানে পুরো বৃত্ত নয়, তার অর্ধেক। যদি আপনি τ ব্যবহার করেন, তাহলে হিসাবটা একেবারেই সরল– τ/৮।

বিশেষ করে ত্রিকোণমিতি নিয়ে যারা কষ্ট পায়, τ তাদের জন্য হতে পারে এক সহজ পথ। সাইন-কোসাইন ফাংশনের গ্রাফ যেভাবে প্রতি ২π–তে পুনরাবৃত্ত হয়, সেখানে π বোঝায় আধা তরঙ্গ, আর τ বোঝায় পূর্ণ তরঙ্গ; যা অনেক বেশি বোধগম্য।

সমাধান কী?
যুক্তরাষ্ট্রের পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতবিষয়ক সাংবাদিক এমিলি কনোভার বলেন, ‘পাই এতটাই শিকড় গেড়েছে যে একে বাদ দেওয়া কঠিন। তবে শিক্ষায় পাইয়ের পাশাপাশি τ-এর ব্যবহার শুরু করা যেতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ত্রিকোণমিতি অনেক সময় শিক্ষার্থীদের মনে গণিতভীতি তৈরি করে। অথচ গণিত বোঝা, শেখা, এমনকি উপভোগ করাও সম্ভব। শুধু দরকার, আরও বুদ্ধিদীপ্ত ও সহানুভূতিশীল শিক্ষাদান।’ তিনি নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমি আর পাই দিবস উদযাপন করি না। বরং ২৮ জুনই আমার জন্য গণিতের সরলতার দিন– টাউ দিবস।’

π আর τ এখন গণিতপ্রেমের দুটি ধারা। কেউ ঐতিহ্যের ধ্রুবক, কেউ যুক্তির চিহ্ন। এই বৃত্তের মাঝেই ঘুরপাক খায় প্রশ্ন, কৌতূহল আর গণিতচর্চার আনন্দ।

তথ্যসূত্র: দ্য টাউ ম্যানিফেস্টো, সায়েন্স নিউজ

আরও পড়ুন

×