শ্রদ্ধাঞ্জলি
বিরল গবেষকের বিদায়

ড. গোলাম মুরশিদ (১৯৪০-২০২৪)
ইফতেখারুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৪ | ২৩:৫৬ | আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২৪ | ১২:১৪
বাংলা সাহিত্য গবেষণায় আমাদের একজন দিকপাল ছিলেন। তিনি ড. গোলাম মুরশিদ। ৪০টির মতো বই লিখেছেন, যার কয়েকটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কালজয়ী হয়ে টিকে থাকবে। বিশেষত মাইকেল মধুসূদনকে নিয়ে তাঁর কাজ গবেষণা পদ্ধতিতে নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে তাঁর লেখা ‘রণক্লান্ত নজরুল’ নতুন তর্কের সূচনা ঘটিয়েছে।
বৃহস্পতিবার লন্ডনে ৮৪ বছর বয়সে এই প্রথিতযশা লেখক আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ১৯৪০ সালে তিনি বরিশালের মর্যাদাসম্পন্ন এক শিক্ষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবারের অধিকাংশই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বরণ করেছেন।
গোলাম মুরশিদের কয়েকটা ক্লাসে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি, তাতে মনে হয়েছে, তিনি জাত শিক্ষক। ঘোষ ও অঘোষ ধ্বনির ব্যাপারে তাঁর উপস্থাপনায় যতটুকু সৃজনশীলতা ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল শেখানোর অদম্য বাসনা। সত্যিকার অর্থে এ ধরনের শিক্ষক সারা পৃথিবীতেই বিরল হওয়ার কথা।
বছর দুয়েক আগে তিনি একবার ফোনালাপে বলেছিলেন, ‘এই বয়সে বিকেলে কেন ঘুমাবে? এখন সবকিছু পেছনে ফেলে পড়াশোনা করার সময়। আমি এখনও বিকেলে বিশ্রাম নিই না।’ জ্ঞানের প্রতি তাঁর যে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দেখেছি, তাতে বারবার মুগ্ধ হয়েছি। এ কারণে অশীতিপর এই শিক্ষক আমাদের কাছে সবসময় তরুণ ছিলেন। বলা বাহুল্য, আমি কখনও তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু তিনি আমার মতো অনেকের কাছে শিক্ষকতুল্য ছিলেন। তিনি বলতেন, গুরু কে? যিনি গৌরব দিতে পারেন তিনিই গুরু। আমাদের অনেকে তাঁর কাছে গিয়ে গৌরবান্বিত হয়েছি। স্পষ্ট বাচনভঙ্গি, মেদহীন উপস্থাপনা ও কোদালকে কোদাল বলার কারণে তিনি ছিলেন অনন্য এক ব্যক্তিত্ব।
কেবল শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে তিনি অসাধারণ ছিলেন, তা কিন্তু নয়। অভিভাবক ও মানুষ হিসেবেও অতুলনীয়। অসুস্থ হওয়ার খবর পেয়ে লন্ডন থেকে তিনি এই নগণ্য তরুণের জন্য ভিটামিনযুক্ত ওষুধ নিয়ে এসেছিলেন। বাসায় অনেকবার এলিজা ম্যাডাম স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে খাইয়েছেন। এই স্মৃতি সবসময় মনে গেঁথে থাকবে। ঢাকায় অনেক তরুণ স্যার ও ম্যাডামের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। এসব গুণে তিনি আমাদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন একজন অসাধারণ অভিভাবক।
বাঙালি সংস্কৃতি, নজরুল নিয়ে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থানের কারণে গোলাম মুরশিদ বিতর্কিতও কম নন। চিন্তাভাবনায় তিনি ছিলেন অজ্ঞেয়বাদী। কিন্তু ঈশ্বর যে গুণে গুণান্বিত– দয়া, মায়া, প্রেম, ভালোবাসা, ন্যায়পরায়ণতা– সবক’টিই তাঁর মধ্যে ছিল ষোলো আনা। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম হিসেবে তিনি অনেকের মতোই রাষ্ট্রীয়ভাবে বহু সুযোগ-সুবিধা ও পুরস্কারে ভূষিত হতে পারতেন। তিনি কখনও এসবের ধার ধারেননি। সারাজীবন পড়াশোনায় মগ্ন থাকতে চেয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত আমার শিক্ষকতুল্য সত্তরোর্ধ্ব এক অধ্যাপক বলেছিলেন, ‘আমি সারাজীবন মুরশিদ ভাইয়ের মতো হতে চেয়েছি। বই ও গবেষণার মধ্যেই নিজেকে কল্পনা করেছি।’
পেশাজীবনে মুরশিদ কয়েক দশক সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকলেও গবেষণা কখনও তাঁর পিছু ছাড়েনি। তিনি দেশে ও বিদেশের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা করেছেন। আশির দশকের মাঝামাঝি তিনি বিলেত গিয়ে বিবিসি বাংলায় যোগ দেন। সেখানে সংস্কৃতি নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করতে গিয়ে দেখলেন, এ বিষয়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা নেই। এই তাগিদে লিখে ফেললেন ৪০০ পৃষ্ঠার একটা বই, যার নাম দেন ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’। এর পর একের পর এক গবেষণা। তাঁর কয়েকটি বই আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানে বাঁক বদল ঘটিয়েছে। ‘নারী প্রগতির একশো বছর: রাস সুন্দরী থেকে রোকেয়া’ ও ‘আধুনিকতার অভিঘাতে বঙ্গরমণী’র কথাই ধরা যাক। কিংবা ‘মধুর খোঁজে: মাইকেলজীবনী পুনর্নির্মাণের নেপথ্য কাহিনী’।
বাঙালি নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা প্রগতির গোড়া খুঁজতে গেলে মুরশিদের বই দুটির কাছে আমাদের যেতেই হবে। একইভাবে মধুসূদন পাঠে একই কথা প্রযোজ্য। ফ্রান্সে গিয়ে ফেলুদার মতো তিনি অনেক অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন, যার মধ্য দিয়ে মধুসূদনের অনেক রহস্যের জট খুলেছিল। বলা চলে, এরই মধ্য দিয়ে মুরশিদ গবেষণায় যেন নতুন করে ‘ফেলুদা পদ্ধতি’র আবির্ভাব ঘটালেন। সব শেষে তিনি ‘বাংলা গানের ইতিহাস’ বইটি লিখেছিলেন। এতে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরের বিস্তৃতি ফুটে ওঠে।
লন্ডনে থাকাকালীন প্রতিদিন মুরশিদ গবেষণায় নিমগ্ন ছিলেন। সেটা ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে হোক কিংবা তাঁর বাসায়। পত্রিকার ছোট্ট পরিসরে এই বিশাল মানুষকে তুলে ধরা বেশ কঠিন। সব শেষে একটি কথাই বলব, পাণ্ডিত্যের পথ শেষ বলে কিছু নেই। আমাদের মধ্যে গোলাম মুরশিদ তেমনই একজন মানুষ ছিলেন, যিনি সারাজীবন জ্ঞানচর্চার পথেই হেঁটেছেন।
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
[email protected]
- বিষয় :
- শ্রদ্ধাঞ্জলি
- গবেষক
- মতামত