চাকসু নির্বাচনের আমেজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে
শক্তি প্রদর্শনে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির

প্রায় তিন যুগ ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হওয়ায় প্রাণহীন পড়ে আছে চাকসু ভবন সংগৃহীত
মেহেদী হাসান, প্রদায়ক, চবি
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫ | ০০:৪৩
সমাবর্তনের ব্যস্ততা শেষ হতেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। চাকসু নির্বাচন ঘিরে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির নিয়মিত কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান সংহতের চেষ্টা করছে। দুটি ছাত্র সংগঠনই কর্মী সংগ্রহ করছে। পাশাপাশি সক্রিয় হতে শুরু করেছে নতুন গঠিত সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদও। সংগঠনটিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা অন্তর্ভুক্ত। সব মিলিয়ে দীর্ঘদিন পর চাকসু নির্বাচন কেন্দ্র করে জমে উঠেছে ছাত্ররাজনীতি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগামী জুনে চাকসু নির্বাচন হওয়ার ইঙ্গিত মেলার পর থেকেই ছাত্রসংগঠনগুলো শক্তি প্রদর্শনে নেমেছে।
এদিকে, নানা কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের তৎপরতা জানান দিচ্ছে ইসলামী ছাত্র মজলিস, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (স্যাড), ছাত্র অধিকার পরিষদ, গাউছিয়া কমিটি, ক্লাব অ্যালায়েন্সসহ নানা সংগঠন।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ৯ মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন, আবাসন, খাবার ও একাডেমিক সেবাসহ নানা বিষয়ে সংস্কারের দাবি তুলে কয়েকটি ছাত্র সংগঠন আন্দোলন করেছে। এখন সংগঠনগুলোর সব আয়োজন চাকসু নির্বাচন ঘিরেই। প্রায় তিন যুগ পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মো. সাইফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘আমরা বরাবরই শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির সাথে একাত্মতা পোষণ করে এসেছি এবং তাদের দাবির ভিত্তিতে কাজও করেছি। চাকসু শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের কেন্দ্রবিন্দু। সুতরাং চাকসুকেন্দ্রিক প্রশাসনের যেসব কার্যক্রম হওয়া দরকার, সেগুলো চলমান আছে। যতদিন না চাকসু সক্রিয় হবে, ততদিন পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলমান থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চাকসু নির্বাচনের আগে কিছু প্রস্তুতি থাকে, সেগুলো নিয়ে প্রশাসন কাজ করছে। আমরা যখন মনে করব, চাকসু নির্বাচন দেওয়া উচিত, তখনই নির্বাচন আয়োজন করব।’
এদিকে, নির্বাচনী হাওয়া বইতেই চাকসুর খসড়া গঠনতন্ত্র উপস্থাপন করেছে প্রশাসন। গত ২২ মে এক মতবিনিময় সভায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা হয়, যেখানে ৩১টি পদ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে গঠনতন্ত্রে কোনো সংশোধনী থাকলে আগামী ২৬ মে’র মধ্যে লিখিতভাবে জানাতে বলা হয়েছে। উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) ড. কামাল উদ্দিন জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন করা হবে।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় প্রভাব দেখা গেছে। ওই সময় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যেই ধীরে ধীরে ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের বিভিন্ন কার্যক্রম দেখা যায়। নিয়মিত সমাবেশ, রাজনৈতিক সভা, আলোচনা সভা, নবীনবরণ, পাঠচক্র ও ইফতার মাহফিল করতে দেখা গেছে এই দুই ছাত্র সংগঠনকে। এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতারাও।
অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম না চালালেও বর্তমানে তারা বেশ সক্রিয়। অঙ্গসংগঠনের মাধ্যমেও সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে দেখা গেছে শিবিরকে। গত রমজান মাসে ২০ দিনব্যাপী গণ-ইফতার আয়োজন করে শিবিরের সামাজিক সংগঠন ‘মিনার’।
ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মোহাম্মদ আলী সমকালকে বলেন, ‘দীর্ঘ ৩৫ বছর পর চাকসু নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, তা ইতিবাচক। ১৯৯০ সালের পর থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল এবং অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ছাত্র সংসদ কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল। চাকসুর মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব তৈরি হবে, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে, এটা আমাদের আশা। অভ্যুত্থানের পর থেকেই আমরা চাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি এবং সব সময় শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এখন নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনে আগ্রহী।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের কার্যক্রম সব সময়ই ছিল। ৫ আগস্টের পর ক্যাম্পাস স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, আমরাও সক্রিয়ভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেছি। নিয়মিত পাঠচক্র, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। হল ও ফ্যাকাল্টিভিত্তিক সদস্যরা সক্রিয় রয়েছেন। শুধু শোডাউনের রাজনীতি ছাড়াও শিক্ষার্থীদের কল্যাণমূলক রাজনীতি কীভাবে করা যায়, তা আমরা দেখিয়েছি। চাকসুতে আমাদের সমর্থন থাকবে।’
পাঁচ আগস্টের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সরব অবস্থান দেখা গিয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপস্থিতি কমেছে। চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি ঘোষণা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি হয়নি। আবার
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদেরও কমিটি নেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটি হওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কার্যক্রম নেই। একটি ইফতার মাহফিল ছাড়া আর কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি সংগঠনটির।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব আল মাশনূন বলেন, ‘আমরা শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্র সংসদ চালুর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। আজও অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী জানে না চাকসু কী, বা তারা কীভাবে এর অংশ হতে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন সুবিধা রয়েছে, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ক্লাস শেষে শাটল ট্রেনে শহরে ফিরে যায়। এই বাস্তবতায় তাদের মধ্যে চাকসুবিষয়ক সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জানি বিগত সময়ে কেন চাকসু হয়নি। সেই কারণগুলো ভুলে গেলে চলবে না। যারা এই প্রতিষ্ঠানের পথ রুদ্ধ করেছিল, তাদেরও এর দায় নিতে হবে।’
অভ্যুত্থানের পর থেকে ছাত্রদল প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। প্রথম দিকে প্রশাসনের প্রতি তাদের অনাস্থা থাকলেও বর্তমান সময়ে, চাকসু নির্বাচন নিয়ে সংগঠনটি বেশ সক্রিয়। ছাত্রদলের নেতারা চাকসু বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছেন।
ছাত্রদল সভাপতি আলাউদ্দিন মহসিন বলেন, ‘চাকসু শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। বছরের পর বছর বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন সক্রিয় থাকলেও প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে চাকসু নির্বাচন হয়নি। এখন চাকসু নির্বিাচনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং সংগঠনকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমলে আমাদের নেতাকর্মীরা সেভাবে ক্যাম্পাসে আসতে পারেনি। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে আমরা সাংগঠনিকভাবে নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছি এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করে যাচ্ছি। চাকসু নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার নিয়ে আরও বেশি সচেতন ও সক্রিয় হবে।’
ছাত্র কাউন্সিলের নেতা ধ্রুব বড়ুয়া বলেন, ‘বর্তমান প্রশাসন পক্ষপাতিত্ব করে। প্রশাসনের পরিশোধনের মাধ্যমে আমরা চাকসু নির্বাচন চাই। চাকসু নির্বাচন যেন কোনো বিশেষ সংগঠনের স্বার্থে ব্যবহৃত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ থাকে, তবে আমরাও নির্বাচনে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করতে পারব। আমরা চাই সকলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ নির্বাচন।’
- বিষয় :
- বিশ্ববিদ্যালয়