ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

প্যারিস মাতানো আমাদের মেহনাজ

প্যারিস মাতানো আমাদের মেহনাজ

আইদা মেহনাজ, ছবি: ইন্সটাগ্রাম

--

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২১ | ২০:৫২

আইদা মেহনাজ। মাত্র ২৬ বছর বয়স। এই বয়সেই ফ্যাশনের রাজধানী প্যারিস দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশি তরুণী আইদা মেহনাজ। তবে তিনি ফ্যাশন ডিজাইনার নন, তার ক্ষেত্র ফ্যাশন কমিউনিকেশন। বায়োকেমিস্ট্রিতে স্নাতক করলেও তার বিশেষ টান ফ্যাশনে। বাংলাদেশি এই তরুণী ফ্যাশন ডিজাইনার প্যারিসের ফ্যাশন স্কুল এসমদ-এর সিনিয়র ব্র্যান্ড ইমেজ অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স কো-অর্ডিনেটর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তাকে নিয়ে লিখেছেন মুনতাসির রশিদ খান

মাত্র ২৬ বছর বয়স। এই বয়সেই ফ্যাশনের রাজধানী প্যারিস দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশি তরুণী আইদা মেহনাজ। তবে তিনি ফ্যাশন ডিজাইনার নন, তার ক্ষেত্র ফ্যাশন কমিউনিকেশন। বায়োকেমিস্ট্রিতে স্নাতক করলেও তার বিশেষ টান ফ্যাশনে। সেই ঝোঁক থেকেই ধীরে ধীরে পৌঁছলেন সাফল্যের উচ্চশিখরে। এক বছর আগে প্যারিসের বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এসমদ থেকে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন অ্যান্ড লাক্সারি ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করেন আইদা। ২০১৯ সালেই মাস্টার্সের ফাইনাল ইয়ারের ছয় মাসের ইন্টার্নশিপের জন্য যোগ দেন বিখ্যাত ব্র্যান্ড থিয়েরি মুগলারে। পরে স্পেশালাইজেশন করেছেন ব্র্যান্ড কমিউনিকেশনে। অন্যদিকে ইন্টার্নশিপ শেষ হওয়ার পরও থিয়েরি মুগলার নামের ওই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান তাকে ছাড়েনি। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড ইমেজ অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেন। তার দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে ২০২১ সালের শুরুতেই পদোন্নতি দেওয়া হয় তাকে। তিনি এখন প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র ব্র্যান্ড ইমেজ অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করছেন।

যেভাবে এলেন ফ্যাশন জগতে
আইদা মেহনাজ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে বায়োকেমিস্ট্রিতে স্নাতক করেছেন। তবে উচ্চতর শিক্ষায় তিনি নিয়েছেন ফ্যাশন কমিউনিকেশন। নর্থ সাউথে পড়ার সময়ই তিনি মডেস্ট ফ্যাশন নিয়ে অ্যাডভোকেসি শুরু করেন। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে অনেকেই নিয়মিত যোগাযোগ করেন তার সঙ্গে। ২০১৫ সালে ইন্দোনেশিয়া ফ্যাশন উইক চলাকালে তিনি আমন্ত্রিত হন বক্তা হিসেবে। ঢাকায় থাকার সময়েই তিনি ফ্যাশন কমিউনিকেশন নিয়ে কাজ করতেন। লিখতেন নিজের ব্লগে। করতেন ভিডিও। এরই মাঝে খণ্ডকালীন কাজ শুরু করেন ফ্যাশন ব্র্যান্ড সেইলরে। পরে ফ্যাশন কমিউনিকেশনে পড়ার জন্য তিনি নিউইয়র্ক ও প্যারিসে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করেন। একাধিকবার ইন্টারভিউ দিয়ে বেশ কঠিন পথ পার করে এসমদে সুযোগ পান। সেখানে দুই বছর পড়াশোনা করেন তিনি। পড়াশোনার সময়ই তিনি ইন্টার্ন করেন শীর্ষ সারির প্রেস এজেন্সি কেসিডিতে। এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় তার সুযোগ হয় বালমেঁ, ইসাবেলা মারান্ত, ভ্যালেন্তিনো, গুচি ও রিক ওয়েন্সের মতো একাধিক ফ্যাশন ও কসমেটিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করার। ফলে প্রত্যেকের ব্র্যান্ড ইউনিভার্স আর তাদের বৈশিষ্ট্য, অনন্যতা, ব্র্যান্ড ডিগনিটি ও কালচার জানার সুযোগ হয়। যে অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে কাজে লাগে তার। সম্প্রতি মডেস্ট ফ্যাশন কাউন্সিল তাকে রিজিওনাল ডিরেক্টর পদে মনোনীত করেছে।

করোনার দিনলিপি
২০২০ সালে করোনা তোলপাড় করে দেয় বিশ্ব। সেই ঝক্কি এখনও সামলে উঠতে পারছে না মানুষ। এর ভেতরেও সচল ছিল আইদার ব্যবসা। তিনি থাকতেন প্যারিসে একটি সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টে। এই অ্যাপার্টমেন্টের হোটেল সেকশনও আছে। হোটেলের একটি রুম ভাড়া করে বিভিন্ন মৌসুমের সব পোশাক এনে রাখেন আইদা। তারপর এখানে বসেই কাজ শুরু করেন। যোগাযোগ শুরু করেন বিভিন্ন পত্রিকা ও তারকাদের সঙ্গে। এ ছাড়া ফটোশুটের জন্য মডেল নির্বাচন থেকে ফটোশুট সবই তিনি করেছেন এখানে বসে। রাজ্যের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় এই করোনা। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্যারিস ফ্যাশন উইকে সংগ্রহ উপস্থাপন সরাসরি না করে ফ্যাশন ফিল্ম করে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে দেখানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যে কাজ মোটেই সহজ ছিল না। কারণ, অন্য মডেলদের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্যারিসে নিয়ে এসে শুট করা গেলেও করোনা মহামারির কারণে সুপার মডেল ও শো স্পার বেলা হাদিদকে নিউইয়র্ক থেকে আনা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ব্রুকলিনে একটা স্টুডিও বানিয়ে তার পা থেকে মাথা স্ক্যান করে থ্রি-ডি ইমেজ তৈরি করা হয়। এ জন্য ৫০০ ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। আর লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস ও জার্মানিতে অ্যানিমেশনের কাজ হয়। কিন্তু সেটা মনমতো না হওয়ায় ২৮ সেপ্টেম্বরের নির্ধারিত শো বাতিল করে পরে প্রচার করা হয়। আর এই ফিল্মে বেলাকে মেন্টর হিসেবে দেখানো হয়। যেসব সেলিব্রিটি স্বাভাবিক সময়ে ফ্রন্ট রো আলো করেন, তাদের সবার বাসায় পোশাক পাঠানো হয়। তারা সেই পোশাক পরে ছবি তুলে পোস্ট দেন ফিল্ম প্রিমিয়ারের আগে। আর এভাবেই পুরো প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। এমন অসংখ্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন আইদা ও তার প্রতিষ্ঠান। তবে আইদা সবার সঙ্গে তার যোগাযোগ রক্ষা করেছেন রুটিন ধরেই।

২০২০ সালে ২০টি ফ্যাশন সাময়িকীর প্রচ্ছদে
আইদার এই পরিশ্রমের ফলও পেয়েছে তার প্রতিষ্ঠান মুগলার। এত ঝক্কির ভেতরও ২০২০ সালে ২০টি আন্তর্জাতিক ফ্যাশন সাময়িকীর প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছে মুগলারের পোশাক। এই তালিকায় রয়েছে 'ভোগ', 'হারপার বাজার', 'এল'সহ অসংখ্য সাময়িকী। এ ছাড়া 'ভোগ' তাদের বডিসুট নিয়ে আলাদা ফিচার করেছে। এর বাইরে গত বছর এমটিভি ভিডিও অ্যাওয়ার্ডে টপ টেনে থাকা তিনজন ডুয়া লিপা, কার্ডি বি আর বিয়ন্সে পরেন তাদের পোশাক। মুগলারকে ফ্যাশনের প্রত্যাবর্তনকারী ব্র্যান্ড এবং আলটিমেট পপস্টার ব্র্যান্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছে 'ভোগ' সাময়িকী। গর্বের ব্যাপার হচ্ছে, এর পুরো নেতৃত্ব দেন মেহনাজ। আইদা মেহনাজ বলেন, ২০২০ সালে পপ তারকা ছাড়াও আমি কাজ করেছি বেলা হাদিদ, ডেবরা শ'র মতো সুপার মডেলদের সঙ্গে। এ ছাড়া কণ্ঠশিল্পী আরিয়ানা গ্রান্ডের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তবে ভালো লেগেছে তাদের সঙ্গে কাজ করার ফলে আমার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছ থেকে ফুলের বুকে পেয়ে।

এ কী করলেন আইদা!
গত বছরের নভেম্বরের কথা। লন্ডনে একটি শোর জন্য পোশাক প্রয়োজন ব্রিটিশ কণ্ঠশিল্পী ও গীতিকার ডুয়া লিপার। সাধারণত শোয়ের আগে ডুয়া লিপা রেডি-টু-ওয়্যার কালেকশন থেকে পোশাক নেন। কখনও নেন কাস্টমমেড পোশাক। তো এবার ডাক পড়ে আইদার প্রতিষ্ঠানের। আইদা ডুয়া লিপার জন্য পাঠান বেশ কয়েকটি ডিজাইনের স্কেচ। ডুয়ার স্মাইলিং টিম সেই ডিজাইন থেকে একটি পছন্দ করে। এরপর শুরু হয় নকশা অনুযায়ী পোশাক তৈরির কাজ। প্যারিস থেকে সেই পোশাক লন্ডনে পাঠিয়ে ফিটিং দেখা হয়। জুমে পুরো বিষয়টি মনিটর করা হয় প্যারিস থেকে। এরপর প্রয়োজনীয় পরিমার্জন শেষে মূল পোশাক পাঠানো হয় লন্ডনে। কিন্তু বিধি বাম! শোয়ের আগের দিন ডুয়ার স্টাইলিস্ট ফোনে জানান যে, পরার সময় এক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে পোশাকটি। রাতারাতি এটি ঠিক করে দিতে হবে। বসে থাকলে চলবে না। কী করা যায়! প্যারিস থেকে এক টুকরো কাপড়সহ প্লেন ভাড়া করে একজনকে পাঠানো হয় লন্ডনে। তিনি গিয়ে পোশাক মেরামত করে দেন। সেই পোশাক পরে মঞ্চ মাতান ডুয়া লিপা। আইদার এই সফল উদ্যোগের কথা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির মানুষের মুখে মুখে এখন!

আরও পড়ুন

×