ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

নির্মম বাস্তবতা মজুরি বৈষম্য

নির্মম বাস্তবতা মজুরি বৈষম্য

ছবি: সাবিনা আক্তার

আফরোজা চৈতী

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:০৮ | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১২:০৫

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলদেশে নারীর ক্ষমতায়ন, সমঅধিকার নিয়ে অনেক ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, নারীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসার পাশাপাশি পরিবার ও সমাজে একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে। তাঁর কথা বলার আগে যেখানে কোনো জায়গা ছিল না, আজ সেখানে তিনি জোরগলায় অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথেও নামতে পারছেন। ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে অনেক। আবার অনেক ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য আজও আমাদের হতাশ করে। সে রকম একটি হলো শ্রম খাত। নারী শ্রমিকের কাজের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ থেকে ন্যায্য মজুরির অভাব রয়েছে। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাকশিল্পের একটি বড় অংশ এই নারী শ্রমিক; যারা বিভিন্ন সময়ে শিকার হন মজুরি বৈষম্য এবং নির্যাতনের।

আন্তর্জাতিক শ্রম আদালতের (আইএলও) সহযোগিতায় বিআইডিএসের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, ৩০ বছর হওয়ার আগেই ৬০ শতাংশের বেশি নারী তাঁর কর্মক্ষেত্র ছাড়তে বাধ্য হন; যারা নির্যাতন এবং মজুরি বৈষম্যের কারণে কর্মক্ষেত্রে টিকতে পারেন না। আরও একটি জরিপে দেখা গেছে, ৮৪.৭ শতাংশ নারী শ্রমিক পোশাক কারখানায় মৌখিক নির্যাতন বা গালাগালের শিকার হন। ৭১.৩ শতাংশ নারী মানসিক নির্যাতন, ২০ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন এবং ১২.৭ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হন। সেই সঙ্গে মজুরি বৈষম্য তো আছেই। নারী শ্রমিকরাও মেনে নিয়েছেন এই মজুরি বৈষম্য।

একটি পোশাক কারখানায় কাজ করা সুফিয়া জানান, পুরুষ সহকর্মী আর তিনি একই প্রডাকশন দেন। কখনও কখনও বেশি কাজ করেন তিনি। অথচ তাঁর মজুরি পুরুষ সহকর্মীর প্রায় অর্ধেক। তিনি তা মেনে নিয়েছেন। সুফিয়ার মতে, ‘নারীরা তো অর্ধেকই পাবেন।’ তার মানে নারীরা নিজেরাও সচেতন নন তাদের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে।

বাংলাদেশের কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ নতুন নয়। সিলেট, বগুড়া, দিনাজপুর, যশোর, খুলনাসহ সারাদেশে নারী কৃষক ও শ্রমিকের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। বগুড়ার রেহানা জানান, মাঠ থেকে আলু তোলার কাজে তিনি একজন পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় অর্ধেক টাকা পান। কেন অর্ধেক পান? তিনি বলেন, ‘এটাই তো নিয়ম।’ মাঠ পর্যায়ে প্রাপ্ত এসব তথ্য থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, মজুরি বৈষম্য নিয়ে নারীর মধ্যেও রয়েছে সচেতনতার অভাব।

নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য নিয়ে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন হক বলেন, ‘একটি সমাজে যখন নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য বিদ্যমান, তাকে একটি অসুস্থ সমাজ ব্যবস্থা বলা যায়। একটি সমাজে নারী-পুরুষের যে বৈষম্য, তার মূলে রয়েছে অশিক্ষা ও নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সমাজে একজন পুরুষের আয়কে মুখ্য বলে ধরা হয়, নারীর আয় সবসময়ই সেখানে গৌণ বিবেচিত হয়। এ জন্য নারীর মজুরির ক্ষেত্রে আমরা বৈষম্য দেখতে পাই।’

সমাজে নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি তা পাল্টাতে হবে। সে ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক বড় ভূমিকা আছে। আইন দিয়ে বৈষম্য দূর করার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সবকিছু আইন দিয়ে হয় না, কিছু ক্ষেত্রে সমাজ সংস্কারের প্রয়োজন। প্রয়োজন পরিবার থেকেই নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করা।’ শিগগিরই তিনি নারী-পুরুষের এই বৈষম্য দূরীকরণে গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বসবেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন; নারীকেও তাদের অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার হতে হবে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি বলেন, ‘নারীর জন্য সমাজ যেসব কাজ স্বাভাবিক বলে বিবেচনা করা হয়, সেগুলো প্রধানত ঘরের কাজ। নির্দিষ্ট কিছু বাইরের কাজও করা চলে। যেমন– প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, স্বনিয়োজিত অনেক ধরনের কাজ– মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ। পুরো বিশ্বেই এ ধরনের কাজ নিম্নআয়ের। খানিকটা প্রাতিষ্ঠানিক কাজেও সস্তা শ্রমের কারণে নারী নিয়োগের উদাহরণ আমাদের পোশাকশিল্প। কৃষিতে নারী ও পুরুষের শ্রম মজুরির পার্থক্য আছে। এখন ২৫ শতাংশের মতো কম মজুরি পান নারীরা। নারীকেই পরিবারের জন্য অধিকতর সময় দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে এই দেখভাল করার তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন না থাকায় নারী শ্রমশক্তিতে অংশ নিতে পারছেন না। এলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। এটাও বড় কারণ নারীর কম মজুরি পাওয়ার ক্ষেত্রে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নারীর জন্য কর্মপরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনবিরোধী নীতিমালার যে নির্দেশনা উচ্চ আদালত থেকে দেওয়া হয়েছে ২০১০ সালে, সেটি আইনে রূপান্তর করে সব প্রতিষ্ঠানের জন্য বাধ্যতামূলক করা দরকার। সেই সঙ্গে উচ্চপদে নারীর পদায়ন নিশ্চিত করার জন্য আইন, বিচার, অধিকার, সক্ষমতা বৃদ্ধি, নিরাপত্তা সব ক্ষেত্রে কাজ করার প্রয়োজন আছে।’

গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার বলেন, ‘নারীর শ্রম সস্তা। এ জন্যই পুঁজিপতিরা নারীকে নিয়োগ দেন। এ ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন এবং সেই নীতি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার। নারীর যৌন হয়রানি বন্ধের ক্ষেত্রে আমরা কমিশন গঠন করলেও সেটির বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রেই হচ্ছে না।’ তাঁর মতে, গণমাধ্যমের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। নিয়মিত এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে; প্রচার ও প্রকাশনা চালাতে হবে।

নারীনেত্রী এবং ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশী কবির বলেন, ‘নারীরা নিজেরাও বুঝতে পারেন যে তারা মজুরি বৈষম্যের শিকার। এ ক্ষেত্রে তারা প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার সামর্থ্য রাখেন না; কারণ মালিকপক্ষ তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, পোষালে কাজ করবেন, না হলে কাজ ছেড়ে দিতে পারেন। তখন তারা অর্থনৈতিক কারণে বাধ্য হন কম মজুরিতে কাজ করতে। মালিকপক্ষ বেশি মজুরির কাজগুলো পুরুষ শ্রমিকদের দিয়েই করায়, কম মজুরির কাজগুলো বরাদ্দ থাকে নারী শ্রমিকের জন্য। এর কারণ হিসেবে মালিকপক্ষ জানায়, নারীর পক্ষে এসব কাজ করা সম্ভব না বা তারা এসব কাজে দক্ষ নন। সে ক্ষেত্রে নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করার মানসিকতা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবপুষ্ট এসব প্রতিষ্ঠানের নেই। এ ক্ষেত্রে আইনের হস্তক্ষেপ জরুরি। নীতিমালা শুধু প্রণয়ন করলেই হবে না; বরং তার সুষ্ঠু প্রয়োগ ঘটাতে হবে।’

একটি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য সমতা প্রয়োজন। এই সমতা নিশ্চিত হলেই বাড়বে নারীর অধিকার এবং নারীর প্রতি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা। যখন ন্যায় আর সমতায় এগিয়ে যাবে একটি সমাজ তখন একটি দেশও এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির পথে।

আরও পড়ুন

×