ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

বিকল্প মুদ্রায় সাড়া মিলছে না

বিকল্প মুদ্রায় সাড়া মিলছে না

.

ওবায়দুল্লাহ রনি

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪ | ২২:০০

ডলার সংকট মেটাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলারের বিকল্প হিসেবে চীন ও ভারতের মুদ্রায় লেনদেন নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ দুটি দেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। চীনের মুদ্রার পাশাপাশি গত বছরের জুলাইয়ে ভারতীয় রুপিতে আমদানি-রপ্তানির দায় নিষ্পত্তি শুরু হয়েছে। তবে এসব দেশ থেকে যে পরিমাণ আমদানি হয়, তার তুলনায় খুব সামান্য রপ্তানি হয়। ফলে বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনে সাড়া মিলছে না।

বিদ্যমান নিয়মে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) স্বীকৃত পাঁচটি মুদ্রা এবং কানাডিয়ান ডলারে যে কোনো দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির এলসি খোলা যায়। আইএমএফ স্বীকৃত পাঁচটি মুদ্রা হলো– ইউএস ডলার, ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড, জাপানি ইয়েন ও চীনা ইউয়ান রেনমিনবি। বিশ্বের যে কোনো দেশ এসব মুদ্রায় রিজার্ভ রাখতে পারে। যদিও বাংলাদেশের মোট রিজার্ভের ৮৬ শতাংশের মতো রয়েছে ডলারে। স্বর্ণ, ইউরোতে রয়েছে বাকি রিজার্ভ। আর বৈশ্বিক মোট রিজার্ভের অর্ধেকের বেশি ডলারে। আবার সারাবিশ্বের সঙ্গে ব্যাংকের নেটওয়ার্কিংয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাংকের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের। এ ছাড়া আন্তঃব্যাংক আর্থিক লেনদেন নিষ্পত্তির বার্তা পাঠানোর একমাত্র বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশনের (সুইফট) ওপর মূল কর্তৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়লে এ ব্যবস্থায় লেনদেন করতে পারে না। সব মিলিয়ে ডলারেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশের আমদানির বেশির ভাগ হয় চীন ও ভারত থেকে। দেশ দুটির ঋণেও বেশ কিছু প্রকল্প চলমান। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৭৮৩ কোটি ডলারের। মোট আমদানির যা ২৬ দশমিক ১০ শতাংশ। এর বিপরীতে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে দেশটি থেকে ২ হাজার ৮৮ কোটি ডলারের আমদানি হয়, যা ছিল মোট আমদানির ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে রপ্তানি আয় আসে ১ বিলিয়ন ডলারের কম। আর ভারত থেকে বাংলাদেশের মোট আমদানির ১৮ শতাংশের মতো হলেও রপ্তানি হয় সামান্য। বাংলাদেশের বেশির ভাগ রপ্তানি আয় হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো থেকে। দেশের মোট রপ্তানির ৮৫ শতাংশের মতোই হয় এসব দেশে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যবসায়িক লেনদেনের বাইরে বাংলাদেশ এখন বড় সমস্যায় পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের প্রাথমিক কাজের জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধ নিয়ে। অনেক দিন ধরে দেশটির পাওনা প্রায় ৪২০ মিলিয়ন ডলার সোনালী ব্যাংকে ‘স্ক্রো’ হিসাব খুলে জমা করা হচ্ছে। রাশিয়ার অর্থায়নে বাস্তবায়ন হতে যাওয়া এ প্রকল্পে চুক্তিমূল্যের ৯০ শতাংশ বা ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার অর্থায়ন করছে রাশিয়া। প্রকল্পের মূল ঋণ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সালের মার্চ থেকে। এর আগেই লেনদেন নিষ্পত্তির একটি বিকল্প খোঁজা হচ্ছে।
চীনের সঙ্গে সরাসরি লেনদেন চালুর জন্য দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়নায় অ্যাকাউন্ট খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক লেনদেনের বার্তা প্রেরণের মাধ্যম ‘সুইফট’-এর আদলে গড়ে ওঠা দেশটির নিজস্ব ব্যবস্থা সিআইপিএসে যুক্ত হওয়ার আলোচনা রয়েছে। গত মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে এ উদ্যোগ শুরুর পর এখন কার্যক্রম চলছে। এ ব্যবস্থায় যুক্ত হয়ে শুধু চীনের সঙ্গে লেনদেন হবে তেমনটি নয়। বরং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাশিয়ার অর্থায়নে পরিচালিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন ঋণ পরিশোধ হবে চীনের মাধ্যমে। 
এর আগে গত বছরের এপ্রিলে একবার বিকল্প উপায়ে রূপপুরের পাওনা পরিশোধের চেষ্টা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিষেধাজ্ঞার কারণে সরাসরি রাশিয়াকে পরিশোধ না করে পিপলস ব্যাংক অব চায়নার মাধ্যমে পরিশোধের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে একটি প্রটোকল চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। তবে লেনদেন নিষ্পত্তির বার্তা পাঠানোর জন্য এখন পর্যন্ত সুইফটের বিকল্প নেই। এখান থেকে অর্থ পরিশোধ করলে যুক্তরাষ্ট্র জেনে গিয়ে নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কায় শেষ পর্যন্ত আর তা পরিশোধ করা হয়নি। এরপর থেকে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা ও সিআইপিএসে যুক্ত হওয়ার উদ্যোগ সামনে আসে। তবে ডলারের বাইরে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ না থাকায় শেষ পর্যন্ত এ উদ্যোগও থেমে যেতে পারে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগ আসে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে। চীন, ভারতসহ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে রপ্তানি হয় খুব সামান্য। এখন কোনো ব্যবসায়ী যদি ডলারে আয় করে রুপি বা ইউয়ানে আমদানি দায় পরিশোধ করে তাকে ডলার দিয়ে এসব মুদ্রা কিনতে হবে। এতে বিনিময়জনিত লোকসান হবে। আবার ভারত কিংবা চীনা ব্যবসায়ীরা ডলারের বাইরে নিজেদের মুদ্রায় খুব একটা আগ্রহী নয়। যে কারণে খুব অল্প সময়ে ডলারের বিকল্প মুদ্রায় লেনদেন জনপ্রিয় হবে, সেটা আশা করা যায় না।
২০২৩ সালের ১১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় মুদ্রায় লেনদেন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। লেনদেনের সুযোগ তৈরির এক বছর পার হলেও আমদানি ও রপ্তানিতে সাড়া নেই। আবার রুপিতে লেনদেনে জটিলতাও রয়েছে। রুপি আইএমএফ স্বীকৃত না হওয়ায় দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে আলাদা চুক্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হচ্ছে। ভারতীয় মুদ্রায় লেনদেনের বার্তা সুইফটে পাঠানো যায় না। আলাদা চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সোনালী, ইস্টার্ন ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে রুপিতে লেনদেন নিষ্পত্তি করতে হয়। আর ভারতের আইসিআইসিআই ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া সেখানে এলসি নেয়। তবে ব্যাংকগুলো চাইলেই রুপিতে এলসি খুলতে পারবে না। কেবল যে পরিমাণ রপ্তানি আয় আসবে, সমপরিমাণ আমদানি নিষ্পত্তি করা যাবে। ডলার দিয়ে রুপি কিনে আমদানি দায় নিষ্পত্তি করা যাবে না। অন্যদিকে চীনা মুদ্রা ২০১৬ সাল থেকে আইএমএফ থেকে রিজার্ভ মুদ্রার স্বীকৃতি পায়। আইএমএফের স্বীকৃতির পর ২০১৮ সালে এখানকার ব্যাংকগুলোকে ইউয়ানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। আর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এলসি খোলার অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। স্বীকৃত মুদ্রা হওয়ার পরও চীনা মুদ্রায়ও এলসি হয় খুব সামান্য।

আরও পড়ুন

×