ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

কর্ণফুলীর তীর দখল করে সাম্রাজ্য আ’লীগ নেতার

কর্ণফুলীর তীর দখল করে সাম্রাজ্য আ’লীগ নেতার

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে অবৈধ বালুমহাল। ড্রেজার দিয়ে প্রতিদিন তোলা হচ্ছে বালু। ছবি: মো. রাশেদ

 আহমেদ কুতুব, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২৪ | ০০:৩১ | আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২৪ | ১২:০৫

চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতু এলাকায় ১৯৮৫ সালে প্রশস্ততা ছিল ৯৫২ মিটার। দখল ও ভরাটে তা এখন ৪৪৬ মিটারে নেমে এসেছে। এ নদীর বুকে ভরাট হওয়া জমিতে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন মহিউদ্দিন বকুল নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা। ভরাট হওয়া জায়গায় তিনি বসিয়েছেন বরফকল। সাগর থেকে নিয়ে আসা মাছ সংরক্ষণের জন্য করেছেন কোল্ডস্টোরেজ। অবৈধ বিশাল বালুমহালও তৈরি করছেন নদী পাড়েই। এমনকি একটি বিশাল ট্রাকস্ট্যান্ডও খুলে বসেছেন। 

নদীতীরের সরকারি জায়গায় একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। প্রতিদিন বরফকল ও কোল্ডস্টোরেজের বর্জ্য কর্ণফুলীতে পড়ে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। ক্রমাগত দখল, ভরাট ও ইজারা প্রক্রিয়ার কারণে ৩৯ বছরে নদীটির প্রশস্ততা কমছেই। 

উচ্চ আদালত এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করার নির্দেশ দিলেও বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে মহিউদ্দিনের অবৈধ সাম্রাজ্য। নদী কমিশন এসব বরফকল, মাছ বাজার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য বারবার তাগাদা দিলেও রহস্যজনক কারণে কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নদীর জায়গা ইজারা নিয়ে বরফকল, কোল্ডস্টোরেজ গড়ে তোলেন মহিউদ্দিন। তার পাশাপাশি কর্ণফুলী ঘিরে মাছ বাজারসহ দুই হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলেছেন প্রভাবশালীরা। 

নদী রক্ষায় পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ ২০১০ সালে হাইকোর্টে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের আবেদন জানিয়ে রিট করে। ২০১৬ সালে হাইকোর্ট কর্ণফুলী তীরে গড়ে ওঠা স্থাপনাগুলো অবৈধ উল্লেখ করে উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। তার পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক লোক দেখানো কিছু স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও বেশির ভাগই রয়ে যায় অক্ষত।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান বলেন, ২০১৯ সালের মে মাসে কর্ণফুলী তীরের ২ হাজার ১৮১টি স্থাপনাকে অবৈধ চিহ্নিত করে সুপ্রিম কোর্ট উচ্ছেদের চূড়ান্ত নির্দেশ দেন। তবে জেলা প্রশাসন ও বন্দর কর্তৃপক্ষ এ রায় বাস্তবায়ন করছে না। 

উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী, জেলা প্রশাসন ও বন্দর কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই নদীর উভয় তীরের সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীকে ২০০০ সালের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। নদীতীরে বরফকল, কোল্ডস্টোরেজ, বালুমহাল, দোকান ও ঘরবাড়ি সবই অবৈধ। 

অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন বকুল বলেন, কর্ণফুলী নদীতীরে তাঁর বরফকল, কোল্ডস্টোরেজ, বালুমহাল, ট্রাকস্ট্যান্ড থাকলেও সবকিছুর অনুমতি রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বরফকল ও কোল্ডস্টোরেজ করার অনুমতি  নিয়েছেন। হাজী চাঁন মিয়া সওদাগর থেকে নদীপাড়ের জায়গা লিজ নিয়ে বালুমহাল ও ট্রাকস্ট্যান্ড করেছেন। তাঁর ইটিপি প্লান্ট না থাকলেও বরফকল ও কোল্ডস্টোরেজের বর্জ্য নদীর পানিকে দূষিত করছে না। নদীর খাসজমি লিজ সম্পর্কে বলেন, চাঁন মিয়ারা এসব জমি তাদের দাবি করে আদালতে একটি মামলা করেছেন। মামলা নিষ্পত্তি না হলেও তাদের থেকে দলিলমূলে তিনি জায়গা লিজ নিয়ে বৈধভাবে ব্যবসা করছেন।

পরিবেশবিদ অধ্যাপক ইদ্রিস আলী সমকালকে বলেন, দেশের ৯২ শতাংশ অর্থনীতি সচল রাখে কর্ণফুলী নদী। কিন্তু বরফকল ও কোল্ডস্টোরেজের তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিপত্তি ঘটিয়ে চলছে। বরফকলের কার্যক্রমের দূষণ নদীকে বহন করতে হচ্ছে। দূষণের কারণে নদীতে বাস্তুতান্ত্রিক এবং অণুজীবের শৃঙ্খলায় বিপত্তির সৃষ্টি হয়। মাটির পুষ্টি দূষণ ঘটে, অভিযোজন সংকট হয়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজামান বলেন, মামলাসহ নানা কারণে প্রশাসনের উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। মাছ বাজার নিয়ে ব্যবসায়ীরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। আদালত বলেছেন, পুনর্বাসন করে তাদের উচ্ছেদ করতে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নদীর সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত উচ্ছেদ কার্যক্রম চালিয়েছিল জেলা প্রশাসন। বারিক বিল্ডিং থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত উচ্ছেদ চালায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। দু’পক্ষ মিলে হাজারখানেক স্থাপনা উচ্ছেদ করে। তবে তাদের কেউই হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের উচ্ছেদ কার্যক্রম শেষ করেনি। 

২০২২ সালের নভেম্বরে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী নদীর অবৈধ স্থাপনা পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসনকে উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার পরও দখলদাররা বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

মহিউদ্দিন বকুল চট্টগ্রামের এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রীর অনুসারী হওয়ায় প্রশাসনের সঙ্গেও তাঁর দহরমমহরম সম্পর্ক। এ কারণে তাঁর স্থাপনা উচ্ছেদ হচ্ছে না বলে জানা গেছে। 

আরও পড়ুন

×