ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

উচ্চারণের বিপরীতে

সরকারের পদক্ষেপ ও সমঝোতার ভবিষ্যৎ

সরকারের পদক্ষেপ ও সমঝোতার ভবিষ্যৎ

মাহবুব আজীজ

মাহবুব আজীজ

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৫ | ০০:৪৩ | আপডেট: ১৩ মে ২০২৫ | ০০:৪৩

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ সরকার ও সংগঠনের দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলি, হত্যাকাণ্ড কারও অজানা নয়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ক্ষমতাচ্যুত নেতৃবৃন্দের শাস্তি নিশ্চিত করাসহ দলটিকে নিষিদ্ধ করবার দাবিও অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব পক্ষ থেকেই ওঠে। তখন থেকেই প্রধান উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টাসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন বলে আসছেন, দোষীদের শাস্তি দেবার পক্ষে তারা; দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করবার পক্ষে সরাসরি সায় নেই। ‘আওয়ামী লীগ কি নিষিদ্ধ হবে বা রাজনীতি করবে কিনা, নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা’– এই প্রশ্নের উত্তরে বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘আমার বরাবরই পজিশন হলো যে, আমরা সবাই এই দেশের নাগরিক। আমাদের এই দেশের ওপরে সমান অধিকার। আমরা সব ভাই ভাই। আমাদেরকে এই দেশেই বাঁচতে হবে। কাজেই যে মত-দল করবে, তার মতো করে, সবকিছু করবে। এই দেশে থেকে কারও অধিকার কেড়ে নেওয়ার কোনো উপায় নাই। কিন্তু যে অন্যায় করেছে, যার বিচার হওয়া উচিত, তার বিচার হবে।’ (বিবিসি, ৩ মার্চ, ২৫)।

তারপর প্রায় আড়াই মাস কেটে গেছে। সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক আলোচনা চলছে; নানা বিষয়ে মতৈক্য ও অনৈক্যের সংবাদ আমরা পাচ্ছি। অপেক্ষা করছি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সমঝোতায় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষিত হবে। এরই মধ্যে, আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে সরকার। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদন দিয়েছে। এই ট্রাইব্যুনাল এখন অপরাধী রাজনৈতিক দল, এর অঙ্গসংগঠক বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবেন।

এদিকে, জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ (সত্য ও সমঝোতা) গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেছেন, ‘অনন্তকাল হানাহানি করে জাতির মুক্তি আসবে না। জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো ঘৃণ্য কাজ যারা করেছে, সংখ্যায় তারা খুব বেশি না। তাদের উপযুক্ত ও যথেষ্ট শাস্তির ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে।’ (সমকাল, ১১ মে, ২৫)।
গণঅভ্যুত্থানের ৯ মাস পেরুনোর পর সরকার রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করছে; অন্যদিকে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনও তৈরি হচ্ছে। এই দুই কার্যক্রমের পারস্পরিক অবস্থান কিছু প্রশ্ন তৈরি করে বৈকি। 

২.
৮ মে থেকে ১০ মে– আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করবার দাবিতে শুরুতে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে ও পরে শাহবাগে আন্দোলনের ডাক দেন গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা ও এনসিপির আঞ্চলিক সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। লক্ষণীয়, এনসিপি সাংগঠনিকভাবে এই আন্দোলন বা সমাবেশ আহ্বান করেনি। বিএনপি বা জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতাকে এই আন্দোলনে দেখা যায়নি। গুরুত্বপূর্ণ বাম সংগঠনগুলোও অনুপস্থিত ছিল। অবশ্য বেশ কয়েকটি ইসলামী দলের তরুণ নেতাকর্মী সমাবেশে ছিলেন; তাদের কিছু কর্মকাণ্ড সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে সমালোচিতও হয়েছে। বিশেষত ‘গোলাম আযমের বাংলায়, আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’ স্লোগানে গণঅভ্যুত্থানজয়ী ছাত্রছাত্রীদের কেউ একমত হবেন বলে মনে হয় না। 

শুধু তাই নয়, সমাবেশে গাওয়া জাতীয় সংগীত এক দলের আপত্তির মুখে মাঝপথে থামিয়ে দিতে বাধ্য হয় তরুণ-তরুণীরা। এসব ঘটনার ভিডিওচিত্র দেখে অনেকের মনে অস্বস্তি ও শঙ্কা জাগে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে যাদের কণ্ঠে ছিল ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ কিংবা যাদের সাহসে কেঁপে উঠেছিল স্বৈরাচারের সিংহাসন; সেই তরুণ-তরুণীরা জাতীয় সংগীত গাইতে পারছে না!
যে তরুণ নেতৃবৃন্দ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গণঅভ্যুত্থান করেছে, তাদের অধিকাংশের অনুপস্থিতি নানা প্রশ্নের অবতারণা করে। কেনইবা সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিদেশ যাবার পরপরই নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী গ্রেপ্তার হবেন? শামীম ওসমানের মতো নেতা সদলবলে নিরাপদে পার পেয়ে যান, আইভীর মতো নেতা গ্রেপ্তার হন! এসবের সঙ্গে নিশ্চয়ই শাহবাগের সাম্প্রতিক আন্দোলনের সম্পর্ক নেই; কিন্তু আকস্মিকতায় মিল রয়েছে। 

৩.
কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার রিকনসিলিয়েশন বা সমঝোতা প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের আদলে একটি ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন করতে পারি! গত দেড় দশকে যেসব অপরাধ হয়েছে, তার ন্যায়বিচার হতে হবে। তারা যেন মনে বল পায়, ন্যায়বিচারে আস্থা রাখে, সেই পরিবেশ তৈরি করা দরকার। তাদের মব ট্রায়ালের কাছে ছেড়ে দেওয়া ভুল হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বিগত শাসনামলে অপরাধের জন্য আওয়ামী লীগের কোনো অনুশোচনা নেই।’ (সমকাল, ৫ জানুয়ারি ২০২৫)।

অনুশোচনাহীন আওয়ামী লীগের প্রতি রিকনসিলিয়েশনের মনোভাব প্রবল বৈরী বিএনপি নেতৃবৃন্দের মধ্যেও স্পষ্ট। বিএনপি ২০২৩ সালের জুলাইতে তাদের দেওয়া ৩১ দফায় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করবার কথা বলেছে।  বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মূল কথা হচ্ছে, রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা আনা। কত লাখ, কত হাজার মানুষের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়? তা করতে গেলে রাষ্ট্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে। ভালো হচ্ছে, রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে সমাধানের দিকে যাওয়া। বিএনপি সেদিকে গেছে, যাতে রাষ্ট্রে শান্তি, স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা যায়’ (সমকাল, ৩ মে ২০২৫)।

রাষ্ট্রে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে মুক্ত ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। সুশাসনের জন্য অপরাধের শাস্তি যেমন অনিবার্য; তেমনি হানাহানি ও হিংসা জিইয়ে রাখা চলে না। গত দেড় দশকে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করলেই যেভাবে ‘বিএনপি-জামায়াত’ ট্যাগিং দেওয়া হতো, তেমনি বর্তমানে ‘মব ভায়োলেন্স’ নিয়ে সমালোচনা করলেই তাঁকে ফ্যাসিবাদের দোসর ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এসবই অগণতান্ত্রিক গোষ্ঠীবাজি আচরণ। রিকনসিলিয়েশন বা পুনর্মিলনের পথে বাধা পারস্পরিক অবিশ্বাস, জিঘাংসা। গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে জিঘাংসা বাদ দিয়ে সকলের প্রতি ছাড় দেওয়ার মনোভাব যেমন থাকতে হবে, তেমনি অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করবার বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া চলবে না। আবার অপরাধীদের নিজেদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অনুশোচনা ও ক্ষমা প্রার্থনার মানসিকতাও থাকতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধোত্তর ৫৪ বছরের রাজনীতিতে আমরা কোনো রাজনৈতিক দলকে কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা বা ক্ষমা প্রার্থনার ভূমিকায় দেখিনি। একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াত যেমন ক্ষমা চায়নি, তেমনি চব্বিশে নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ ক্ষমা চায়নি বা অনুশোচনা প্রকাশ করেনি। বরং আওয়ামী লীগের দেশত্যাগী নেতৃবৃন্দের ফাঁস হওয়া কথোপকথনে পুরোনো দম্ভেরই প্রকাশ দেখেছি। এ অবস্থায় গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে নতুন গণতান্ত্রিক যাত্রায় সব মত ও পথের অংশগ্রহণে অবাধ নির্বাচন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ বন্ধুরই মনে হচ্ছে। 
সমাজের বিপুলসংখ্যক মানুষকে বাদ রেখে রিকনসিলিয়েশনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবার নয়। আবার দম্ভ, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সংঘাত দূরত্বই কেবল তৈরি করে; স্থিতি ও শান্তি আনতে পারে না। সমঝোতা বা রিকনসিলিয়েশন কিংবা মিটমাট যা-ই বলি না কেন, তার জন্য সকলকে ছাড় দিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের স্থিতি-শান্তি ও স্বস্তিকে সবার আগে স্থান দিতে হবে। 

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক 
[email protected]

আরও পড়ুন

×