পুরুষ যখন একা বাবা

.
আফরোজা চৈতী
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:৪৩ | আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৪ | ১২:১৬
একা মায়ের জীবনসংগ্রামের কথা আমরা জানি, কিন্তু একা বাবার কথা সেভাবে উচ্চারিত হয় না। অথবা এটিকে সমাজে বিদ্যমান বিষয় হিসেবে আমলে নিই না। অথচ এই একা বাবারা এ সমাজেই আছেন। একা মায়ের চেয়ে একা বাবার কষ্টটা কোনো অংশে কম না। বরং অনেকাংশে খানিক বেশি।
মেঘলা ও রিয়াদের যখন বিচ্ছেদ হয়, যখন তাদের ছেলের বয়স ৫ বছর। মেঘলা দ্বিতীয় বিয়ে করে সংসার গুছিয়ে নিয়েছেন। সেই ঘরে তাঁর একটি মেয়েও হয়েছে। ছেলে বৃত্ত থাকে বাবার কাছে। মায়ের সঙ্গে সপ্তাহে এক দিন দেখা করতে যায়। আত্মীয়-বন্ধুরা অনেক বোঝালেও রিয়াদ আর বিয়ে করেননি। বৃত্তর সঙ্গেই জীবনটা এক বৃত্তে কাটিয়ে দিতে চান। ছেলের পড়াশোনা, স্কুল, নিজের কাজ– সব সামলে নেওয়াটা প্রথম দিকে অনেক ঝক্কির হলেও পরে মানিয়ে নিয়েছেন রিয়াদ।
আগে কখনও রান্নাঘরে পানিও গরম করেননি রিয়াদ। মায়ের আদরের ছেলে হওয়ায় আর বড় বোনদের কারণে এর প্রয়োজন হয়নি, কিন্তু পরিবর্তিত জীবন তাঁকে এক অন্য আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। অফিস, ঘরের কাজ, ছেলেকে সামলানো– এসব কিছু এক হাতে সামলে আর নিজের একাকিত্বের খোঁজ নেওয়া হয় না। মা মারা যাওয়ার পর বাবা রিয়াদের কাছেই থাকেন। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, তারা দেশের বাইরে থাকেন। মাঝে মাঝে কি ক্লান্ত লাগে না? এ প্রশ্নের উত্তরে রিয়াদ বলেন, ‘লাগে, ভীষণ ক্লান্তি লাগে; তবে কিছু করার নেই। আমার দায়িত্বটা আমাকেই পালন করে যেতে হবে।’
রিয়াদ জানান, নতুন করে আর কোনো সম্পর্কে না জড়িয়ে একা জীবনকেই মানিয়ে নিয়েছেন। একা লাগে না? এমন প্রশ্নে হেসে ফেলেই জবাব দেন, ‘একা লাগার সমাধান তো আর দোকা হয়ে হবে না। কারণ, অপরজন যদি বাবা আর ছেলেকে ঝামেলা মনে করে, তখন তো আরেক অশান্তির সূচনা হবে!’
দুই বছর ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে হেনা মারা যাওয়ার পর মাঝবয়সী হাবিব সাহেব একদম একা হয়ে যান। তাঁর ১২ বছর বয়সী মেয়ে আর ৭ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে যেন অথৈ সাগরে পড়ে যান। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বজনরা দ্বিতীয় বিয়ের পরামর্শ দেন, কিন্তু এটা শোকার্ত হাবিব সাহেব চান না। প্রাথমিক শোক কাটার পর দেখা গেল ছেলেমেয়ে দু’জনেই ডিপ্রেশনের শিকার। এক আত্মীয় এসে কিছুদিন থাকলেও সমস্যার সমাধান হয় না। বরং মেয়ের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। হাবিব সাহেব বুঝে উঠতে পারেন না কীভাবে এই কঠিন সময় পাড়ি দেবেন। তিনি অফিস থেকে ছুটি নিলেন। ঘরে ছেলেমেয়ের সঙ্গে সময় দিলেন। একটু বাইরেও ঘুরে এলেন; কিন্তু শূন্যতারা পিছু ছাড়ে না! জীবন যেন এক ছন্দহীন গান হয়ে গেল!
ওপরের দুটি ঘটনা দুই রকম হলেও দুটো ঘটনায় বাবাদের অবস্থান কিন্তু এক! তাদের সন্তানদের বাবা ও মা দু’জনের দায়িত্বই তাদের কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে। নিজের মনোজগতের অনেক কষ্ট ও শূন্যতা দূরে ঠেলে নিজেকে ঠিক রেখে সন্তানের জন্য একজন আদর্শ বাবা হওয়ার লড়াইটা অত সহজ নয়। তারা প্রথাগত সামাজিকতার সঙ্গে যেন ঠিক খাপ খাইয়ে নিতে পারেন না! এমন কিছু বিব্রতকর প্রশ্নও অনেকে করেন, যেটা নিয়ে বিব্রত হতে হয় সন্তানের সামনেও। হয়তো কেউ একজন বলেন, ‘ভাই, নতুন ভাবি আনেন ঘরে, নতুন মা আনেন আপনার বাচ্চাদের।’ হয়তো ভদ্রলোক সেটি চান না। সন্তানরাই তাঁর প্রথম মনোযোগের কেন্দ্র। সেখানে আর কাউকে বসাতে চান না।
একা বাবা রিয়াদ তাঁর ছেলের জন্য নানা ধরনের রান্না শিখেছেন। অফিসের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ এবং মিটিংয়ের ধকল সামলে বাসায় গিয়ে ছেলের জন্য ভাত রান্নাটাও তাঁর জন্য অন্যতম জরুরি কাজ। ঠিক তেমনি ছুটির দিনে মেয়ের সঙ্গে পিৎজা বানানোটা হাবিব সাহেবের অন্যতম আনন্দের কাজ। এই বাবারা সন্তানের সঙ্গে সুখ-কষ্ট ভাগ করে নেন। সন্তান তখন নিরবচ্ছিন্ন এক পিতৃস্নেহের রক্ষাবলয়ের মাঝে বেড়ে ওঠে। বাবার সঙ্গে সন্তানদের এক দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বলা হয়, পুরুষ ফেমিনিন গুণের অধিকারী যখন হন, তখন তিনি একই সঙ্গে আত্মনির্ভরতার পাশে নিজেকে একজন মমত্বশীল মানুষ হিসেবেও আবিষ্কার করেন। বাবা হিসেবে তিনি নিজেকে নতুন একজন মানুষে রূপান্তর করেন। সেই পুরুষটি তখন নিজের ভেতরে এক অপার মাতৃত্বকে ধারণ করেন।
- বিষয় :
- বাবা-ছেলে
- বাবা
- প্যারেন্টিং