এমএফএসে খরচ ব্যাংকের ৭ থেকে ১৫ গুণ বেশি

মোবাইল আর্থিক সেবা খাত নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানসহ কর্মকর্তারা ফটাে রিলিজ
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৫ | ২৩:৪৪
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, বাংলাদেশে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) পেতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ে ৭ থেকে ১৫ গুণ বেশি খরচ হয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশে এমএফএস সেবার খরচ বেশি। ‘মোবাইল আর্থিক সেবা খাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নগদ উত্তোলনে এমএফএসে খরচ প্রতি ২৫ হাজার টাকায় ২০০ থেকে ৪৬২ টাকা। যেখানে ব্যাংকের খরচ সর্বোচ্চ ২৯ টাকা। ‘সেন্ড মানি’ করতে এমএফএসে ২৫ হাজার টাকায় সর্বােচ্চ খরচ ১৫০ টাকা। অথচ ব্যাংকে কোনো খরচ নেই। ২০২৪ সালে সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা ‘ক্যাশ আউট’-এর ক্ষেত্রে গ্রাহকদের থেকে কমপক্ষে ৪ হাজার ৪১০ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে। যেখানে সমপরিমাণ নগদ উত্তোলনে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আয় করেছে মাত্র ৬৩৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশে এমএফএসে খরচের হার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় অস্বাভাবিক।
প্রতিবেদনে এমএফএস মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণা ও অর্থ পাচার হয় বলে উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এমএফএস ব্যবহার করে জালিয়াতি, প্রতারণা, ঘুষের অর্থ লেনদেন, অনলাইন জুয়ার অর্থ লেনদেন ও পাচারের উদ্বেগজনক চিত্র গবেষণায় উঠে এসেছে। অনলাইন জুয়ায় প্রায় ১ হাজার ১০০ এমএফএস এজেন্ট শনাক্ত করা হয়েছে। শুধু ২০২২ সালেই প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে এমএফএস ব্যবহার করে।
তিনি উল্লেখ করেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বৈদেশিক রেমিট্যান্সের রেকর্ড বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো, এমএফএস ব্যবহার করে অবৈধ হুন্ডি লেনদেন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে (বিকাশ) ২৫ হাজার টাকা নগদ উত্তোলনে ৩৭২ টাকা ৫০ থেকে ৪৬২ টাকা ৫০ পয়সা আদায় করা হয়। যেখানে সমপরিমাণ টাকা উত্তোলনে পাকিস্তানে (ইজি প্যায়সা) ৩৫৫ টাকা ৭০ পয়সা এবং মিয়ানমারে (ওয়েভ পে) ২৩১ টাকা ৩০ পয়সা সেবামূল্য হিসেবে আদায় করা হয়। ভারতে (ফোন পে) এ ধরনের সেবায় কোনো সেবামূল্য আদায় করা হয় না।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, এমএফএস খাত করায়ত্ত করার জন্য রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ করে ‘নগদ’-কে বিশেষ অনৈতিক সুযোগ দেওয়া হয়েছে। জনগণকে আর্থিকভাবে শোষণ, রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি ঘুষ লেনদেন ও অর্থ পাচারের জন্যও এ খাতকে ব্যবহার করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ‘নগদ’-এর পরিচালনাকারী চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান থার্ড ওয়েভ নিয়ম লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত প্রায় ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি তৈরি করেছে। প্রভাব বিস্তার করে সুরক্ষা ভাতা ও উপবৃত্তির অর্থ বিতরণের সুবিধা গ্রহণ, আন্তঃলেনদেন প্ল্যাটফর্ম (বিনিময়) সম্পর্কিত অনিয়ম-দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার ও অবৈধ বৈদেশিক লেনদেনের মতো ঘটনা পাওয়া গেছে। তথ্য বলছে, ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা নগদের শেয়ারহোল্ডারদের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
মোবাইল আর্থিক সেবা খাতে বিদ্যমান সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে ১৩ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করেছে টিআইবি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে এমএফএস খাতের জন্য স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন, লেনদেন খরচ কমানো এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থা সহজ ও সাশ্রয়ী করা, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার আলোকে এ পরিচালন ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো নিশ্চিত করা, এজেন্ট ও পরিবেশকদের কমিশনের সীমা নির্ধারণ, তদারকি নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ নূরে আলম এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট কাজী আমিনুল হাসান।
- বিষয় :
- আর্থিক প্রতিষ্ঠান