জরাজীর্ণ ঢামেক ভবন
প্রদীপের নিম্নে অন্ধকার

প্রতীকী ছবি
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫ | ০০:২৪
ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) বিভিন্ন আবাসিক ও প্রশাসনিক ভবনের জরাজীর্ণ অবস্থাকে দেশের বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থারই প্রতিচ্ছবি বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। মঙ্গলবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৫৫ সালে একমাত্র আবাসিক ছাত্রাবাস শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি হলটি নির্মাণের পর ৭০ বৎসর অতিক্রান্ত। কিন্তু সাড়ে সাত শতাধিক আসনবিশিষ্ট স্থাপনাটির কোনো সংস্কার হয় নাই। ফলস্বরূপ হলটির বিভিন্ন স্তম্ভই শুধু দীর্ণ হয় নাই; ভবনের আচ্ছাদন হইতেও যখন-তখন খসিয়া পড়িতেছে পলেস্তারা। এমনকি সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর ইতোমধ্যে উহার কতিপয় কক্ষকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করিয়াছে। কলেজটিতে অর্ধ সহস্রাধিক ছাত্রীর আবাসনের জন্য ১৯৫০ সালে নির্মিত যেই ডা. আলীম চৌধুরী হল রহিয়াছে, উহার অবস্থাও তথৈবচ। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তদানীন্তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ ভবনকে (বর্তমান ঢামেক হাসপাতালের মূল ভবন) অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পরূপে ব্যবহারের পর যুদ্ধ শেষে ১৯৪৬ সালে তথায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল। বিভিন্ন সময় ভবনের কিছু অংশ বর্ধিত হইলেও কলেজটির অবকাঠামোর উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয় নাই। একদিকে তথাকার শিক্ষার্থীদের জন্য বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা হয় নাই, অন্যদিকে হাসপাতাল ভবনেরও উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ বা উন্নয়নের প্রতি কোনো সরকারের দৃষ্টি পড়ে নাই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও তৎসংলগ্ন হাসপাতাল চিকিৎসক গড়িয়া তুলিবার সহিত চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখিলেও প্রতিষ্ঠার পর হইতে অন্তত প্রতিষ্ঠান দুইটির অবকাঠামো খাত বরাবরই অবহেলিত। ইহা ‘প্রদীপের নিম্নে অন্ধকার’ বাগ্ধারার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
আমরা জানি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর এই ভূখণ্ড পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙিয়া দুই দফা স্বাধীন হইয়াছে; স্বাধীন দেশে অনেক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ ও সমাপন করিয়া যথানিয়ম-অনিয়মে বিদায়ও লইয়াছে; কিন্তু দেশের স্বাস্থ্য খাতের বৃহত্তম প্রদীপটির নিম্নের অন্ধকার দূর হয় নাই। এইরূপ নহে যে, উক্ত সময়ে দেশে কোনো উন্নয়ন হয় নাই। বৃহৎ সময়ে জাতীয় বাৎসরিক বাজেট, তৎসহিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যদ্রূপ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাইয়াছে, তদ্রূপ উহার সহিত পাল্লা দিয়া রাজধানী তো বটেই, দেশের বিভিন্ন শহরেও সরকারি-বেসরকারি খাতে অসংখ্য সুরম্য অট্টালিকা গড়িয়া উঠিয়াছে। সড়ক-সেতুও কম নির্মিত হয় নাই। তবে ইহাও স্বীকার করিতে হইবে, ঐ সকল জাতীয় বাজেটে বিশেষত শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ন্যায় নিবিড়ভাবে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট খাতগুলি প্রত্যাশিত মনোযোগ পায় নাই। যেই কারণে অদ্যাবধি দেশে মানসম্মত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়িয়া উঠে নাই। ফলে দেশের অন্যতম প্রধান চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষাকেন্দ্র ও স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র হইলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জরাজীর্ণ অবস্থা বিস্মিত না করিয়া পারে না।
স্বীকার্য, সর্বশেষ ২০২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত মিলাইয়া ঢামেকের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত দিয়াছিলেন তৎকালীন সরকারপ্রধান। কিন্তু সরকারের আর্থিক সংকটের কথা বলিয়া প্রকল্পগুলিকে হিমাগারে প্রেরণ করা হয়। এমনকি প্রবল ঝুঁকি থাকিবার পরও অন্তত হলগুলির সংস্কারের উদ্যোগ গৃহীত হয় নাই। উক্ত সময়ে অন্য সকল খাতে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে কত লক্ষ কোটি টাকার অপচয় হইয়াছে! এমনকি স্বাস্থ্য খাতে নানা অপ্রয়োজনীয় ও অপরিকল্পিতভাবে যন্ত্রপাতি ক্রয় করিতে গিয়া কত শত-সহস্র কোটি টাকা জলে গিয়াছে। অথচ অর্থের টান পড়িয়াছে ঢামেকের শিক্ষার্থী এবং চিকিৎসাপ্রত্যাশী ও চিকিৎসাদানকারীর জন্য নিরাপদ আবাসন বা ভবন নির্মাণ করিতে গিয়া?
যুগ যুগের এহেন অবহেলা ও বঞ্চনার অবসান ঘটাইতেই ঢামেক শিক্ষার্থীরা গত দুই সপ্তাহ যাবৎ আন্দোলন করিয়া যাইতেছেন। আমরা ইতোমধ্যে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে তাহাদের ন্যায়সংগত আন্দোলনে সমর্থন দিয়াছি। এই আন্দোলনের কারণে কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রহিয়াছে। ইহাতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের যতটুকু ক্ষতি হইতেছে; জাতীয় ক্ষতি তদপেক্ষা কম নহে। তাই সরকারের নীতিনির্ধারকগণ অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের দাবিসমূহ পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করিবেন, ইহাই আমাদের প্রত্যাশা।
- বিষয় :
- সম্পাদকীয়