বুকার
‘মন বাতি’ জ্বালালেন বানু মুশতাক ও দীপা ভাস্তি

অনুবাদক দীপা ভাস্তি ও ‘হার্ট ল্যাম্প’-এর লেখক বানু মুশতাক। মঙ্গলবার লন্ডনে এনবিসি নিউজ
হামিম কামাল
প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫ | ০১:০৩ | আপডেট: ২২ মে ২০২৫ | ০৮:৫৫
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সারস্বত মহলে মুখে মুখে এখন ঘুরছে একটি গল্পগ্রন্থের নাম– ‘হার্ট ল্যাম্প’। বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায়– ‘মন বাতি’। সত্যি সত্যিই বিশ্বজুড়ে পাঠকের হৃদয়ে আলো ছড়াতে শুরু করেছে বইটি।
কন্নড় ভাষার লেখক বানু মুশতাকের রচনা ও দীপা ভাস্তি অনূদিত গল্পগ্রন্থ ‘হার্ট ল্যাম্প’ এবারের আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতেছে। বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি ম্যাক্স পোর্টারের ভাষায়, ‘ইংরেজি পাঠকদের জন্য প্রকৃত নতুন বই।’
‘হার্ট ল্যাম্পে’ স্থান পেয়েছে অনবদ্য ১২টি গল্প। নব্বই দশকের শুরু থেকে সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত, অর্থাৎ ৩০ বছর ধরে লিখিত ও ভারতীয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং গ্রন্থে প্রকাশিত বানু মুশতাকের অসংখ্য গল্প থেকে বিশেষ ১২টি গল্প বাছাই করার কৃতিত্ব অনুবাদক দীপা ভাস্তির। অনূদিত বইয়ের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এ পুরস্কার বিজয়ে অবদান রয়েছে উভয়েরই। পুরস্কারমূল্য ৫০ হাজার পাউন্ড, অর্থাৎ প্রায় ৮১ লাখ টাকা তাই উভয়েই ভাগ করে নিচ্ছেন।
সাধারণ পাঠকের একটি বড় অংশ হয়তো কর্ণাটকের লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী বানু মুশতাকের নাম ও রচনার সঙ্গে সদ্যই পরিচিত হলেন। আপাতত তাঁর রচনার অঙ্গধর্ম ও সত্তাধর্ম বোঝার জন্য অল্প কিছু লেখাপত্রের ওপরই ভর করতে হচ্ছে। হার্ট ল্যাম্প গ্রন্থ থেকে একটি গল্পের চারু অংশ পাঠকের জন্য উপস্থাপন করেছে ম্যান বুকারের ওয়েবসাইট। সেই গল্পে একজন গৃহিণীর আত্মকথন, ধর্মীয় ও সামাজিক ন্যায়বোধের সঙ্গে তার নিজস্ব ন্যায়বোধের দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে, প্যারিস রিভিউর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে ‘রেড লুঙ্গি’ নামে আরেকটি গল্প, সেখানে উঠে এসেছে কিছু দস্যি ছেলের খতনার অনুষঙ্গ, সামাজিক ও শারীর-মানসিক টানাপোড়েন। এর বাইরেও অল্পবিস্তর তাঁর লেখাপত্রের যেটুকু চোখে পড়েছে, সব ক’টিরই একটি সাধারণ পটভূমি রয়েছে– তা হলো, যেসব অস্বাভাবিকতা, অবদমন ও দুরাচারিতা আমাদের চোখের সামনে ঘটে ঘটে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, লেখক সেই সবের অস্বাভাবিকতাকে ললিত ও আণুবীক্ষণিক ভাষায় ‘গল্প’ করে তুলেছেন। আমাদের হৃদয়ে পশে দিয়েছেন।
গল্প বলার একটি বিশেষ ধরনও লক্ষণীয় তা হলো, কোমলে কঠিন। কোমল তার প্রকাশ, অথচ কঠিন তার আঘাত। অবলা, নারী হতে পারে অথবা শিশু– গল্পগুলোয় ভাষা পেয়েছে। অনুবাদ পড়ে তাঁর কন্নড় ভাষাশৈলী অনুমান করা না গেলেও, ভাষার শক্তি অনুবাদের ভেতর দিয়েও অনুধাবন করা যায় এবং এই কৃতিত্ব পেতে পারেন দীপা ভাস্তি।
বুকারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তরুণ লেখক ও অনুবাদক দীপা ভাস্তি তাঁর ঋণ স্বীকার করেছেন লেখক বানু মুশতাকের কাছে। উপমহাদেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বাস করেও পরস্পরের ধর্ম, বোধ ও ভাষা নিয়ে খুব বেশি কিছু কি জানে? রাজনীতি ক্ষেত্রে, উৎসব-অনুষ্ঠানের সর্বজনীনতার প্রশ্নে প্রতি পদেই এই সীমাবদ্ধতার পরিণতি আমাদের ভোগ করতে হয়। অনুবাদে বরাবরই উচ্চাকাঙ্ক্ষী দীপা ভাস্তি এই ব্যবধান উতরে যাওয়াকে রীতিমতো প্রিয় রোমাঞ্চের তালিকায় রাখেন।
বুকার সাক্ষাৎকারে দীপা বলেছেন, যে সম্প্রদায়ের গল্প এখানে বানু লিখেছেন, সেই সম্প্রদায় ও তাদের রীতি, দণ্ড, প্রথা, অন্ত্যজ ভাষা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু তাঁর জানা ছিল না। গল্পগুণেই তিনি সেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে ক্রমশ গভীরভাবে মিশেছেন। যদিও লেখাগুলো কন্নড় ভাষায় লেখা, তবু মুসলমান সম্প্রদায়কে ভালো করে বুঝতে চেয়ে তিনি উর্দু শিখেছেন। এই সমস্ত উদ্যোগ অবশ্যই দীর্ঘসূত্রী এবং সব দীর্ঘসূত্রতায় উদ্যম সরবরাহ করেছেন বানু মুশতাক। ফলে কাজটা সুচারু হয়েছে।
ভারতের কর্ণাটক অঙ্গরাজ্যের হাসান শহরে দেশভাগের পরের বছর ১৯৪৮ সালের ৩ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন বানু মুশতাক। পরাধীন ভারত তাঁকে দেখতে না হলেও ধর্মে ও আদর্শে বহুধাবিভক্ত ভারত, এর সংঘাত ও সহাবস্থান। তাঁর হৃদয়কে আন্দোলিত করেছে, লেখালেখির মানসভুবন তৈরি করে দিয়েছে। অসাম্যের বিরুদ্ধে, নারী-অধিকারের পক্ষে তিনি সোচ্চার। বিশ্বে আদর্শবাদী ভারতীয় নারী সমসাময়িক লেখকদের ভেতর অরুন্ধতী রায় ও ঝুম্পা লাহিড়ীর পর এখন থেকে তাদের সবার চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ, ৭৭ বছর বয়স্কা বানু মুশতাকের নামও উচ্চারিত হবে। হার্ট ল্যাম্প গ্রন্থটি দীপা ভাস্তির সংগৃহীত গল্পগুলোর ইংরেজি অনুবাদ-সংকলন বলে এর কন্নড় নাম নেই এখনও। কন্নড়ভাষী বানু
মুশতাকের অপর পাঠকপ্রিয় গল্পগ্রন্থ– হাসিনা মাত্তু ইতারা কাথেগালু, অর্থাৎ হাসিনা ও অন্যান্য গল্প।
- বিষয় :
- গল্প