ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সখীপুর বিদ্যুৎ কার্যালয়ে ‘ক্ষমতাধর’ এক ঠিকাদার

সখীপুর বিদ্যুৎ কার্যালয়ে ‘ক্ষমতাধর’ এক ঠিকাদার

শফিকুল ইসলাম ঠিকাদার অন্তর

এনামুল হক, সখীপুর (টাঙ্গাইল)

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৩ | ০৭:৫৫ | আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২৩ | ০৭:৫৫

টাঙ্গাইলের সখীপুরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে ‘ক্ষমতাধর’ ব্যক্তি তিনি। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি ও যোগদান অনেকটাই নির্ভর করে তাঁর ইচ্ছার ওপর। প্রতিবাদ করলে পড়তে হয় রোষানলে। হতে হয় হেনস্তার শিকার। অথচ তিনি এই অফিসের কেউ নন! ‘ক্ষমতাধর’ ওই ব্যক্তি হলেন অন্তর আহমেদ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স ফাহিম এন্টারপ্রাইজের’ মালিক তিনি।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম ঠিকাদার অন্তরের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। কথাকাটাকাটির জের ধরে অন্তর মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন বলে জিডিতে উল্লেখ করেন তিনি। 

অফিসের সাধারণ কর্মচারীদের অভিযোগ, অন্তর আহমেদের কথায় সম্প্রতি চার কর্মকর্তাসহ ১১ জনকে বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হয়েছে। তাঁর কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে উপসহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম ও অচ্যুদাস গুপ্ত লিখিত আবেদন করে অন্যত্র চলে গেছেন। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কর্মচারী পরিদপ্তরের পরিচালক বরাবর আবেদন করলে গত ১২ আগস্ট জাহিদুল ইসলামকে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে ও অচ্যুদাস গুপ্তকে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে বদলি করা হয়।

প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম তাঁর বদলির আবেদনে উল্লেখ করেন, অন্তর অফিসে ঢুকে এবং ফিল্ডে যাওয়ার সময় তাঁকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও হেনস্তা করেন, প্রাণনাশের হুমকি দেন। তাঁর এমন কর্মকাণ্ডে সঠিকভাবে দাপ্তরিক কাজ করতে পারছেন না। প্রকৌশলী জাহিদুল সমকালকে বলেন, ‘অফিস যখন বহিরাগতের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তখন সেখানে কাজ করা যায় না।’

একই কথা বলেন উপসহকারী প্রকৌশলী অচ্যুদাস গুপ্ত। সমকালকে তিনি বলেন, ‘বহিরাগতের মাধ্যমে অফিস পরিচালিত হলে সেখানে সম্মান নিয়ে কাজ করা যায় না। সরকারি কর্মকর্তা হয়ে এর বেশি বলা সম্ভব নয়।’

স্থানীয়দের অভিযোগ, ট্রান্সফরমার ও বিদ্যুৎ লাইন স্থাপনে অবৈধ অর্থের লেনদেন হয় অন্তরের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম ভাঙিয়ে সখীপুর বিদ্যুৎ অফিসে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকাদার অন্তর। কিন্তু চাকরি হারানোর ভয়ে অফিসের কেউ মুখ খোলেন না। 

অন্তরের বাড়ি ময়মনসিংহের ভালুকার গুবুদিয়া নয়নপুর গ্রামে। ২০০৬ সালে তিনি সখীপুরে আসেন। অন্তর তখন ভ্যান চালাতেন এবং বিদ্যুৎ বিলের কাগজ বাসবাড়িতে পৌঁছে দিতেন। ঘুষ নিয়ে মিটিয়ে দিতেন বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের মামলা। এক পর্যায়ে টাকা নিয়ে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া শুরু করেন। অন্তর এরপর যোগ দেন রাজনীতিতে। বাগিয়ে নেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই ২০২০ সালে পান বিদ্যুতের ঠিকাদারি লাইসেন্স। 

এভাবে সখীপুর বিদ্যুৎ কার্যালয়কে ব্যবহার করে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন অন্তর আহমেদ। গড়গোবিন্দপুরে জমি কিনে তৈরি করছেন বহুতল ভবন। ২৮ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছেন প্রাইভেটকার।

স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোতালেব হোসেন গুর্খা বলেন, ‘মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে তোলা সেলফি অন্তরের মূল পুঁজি। ওইসব ছবি দেখিয়ে প্রভাব খাটিয়ে চলেছেন অন্তর। মালিক হয়েছেন বিপুল অর্থ-সম্পদের। গড়ে তুলেছেন একটি চক্র, যাদের কার্যকলাপে অতিষ্ঠ এলাকার মানুষ।’ 

গত ফেব্রুয়ারিতে সখীপুর থেকে বদলি হয়ে বগুড়া বিদ্যুৎ কার্যালয়ে গেছেন উপসহকারী প্রকৌশলী শামসুল আলম। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ঠিকাদার অন্তরের কর্মকাণ্ড বিদ্যুৎ কার্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের জন্য অশনিসংকেত। এটি বন্ধ না হলে দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা সেখানে যাবেন না। সেবাবঞ্চিত হবে এলাকার মানুষ।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বদলি হওয়া দুই কর্মচারী বলেন, ‘অন্তরের কথার বাইরে যেতে পারেন না সখীপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর তালুকদার। কারণ সখীপুরে তাঁর পদায়নে অন্তরের হাত রয়েছে।’ 

এলাকার ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী মো. সোহেল এক সময় অন্তরের সঙ্গে ভ্যান চালাতেন। বিদ্যুতের চোরাই তার বহনের অপরাধে কিছুদিন আগে দুই মাস জেল খাটেন তিনি। সোহেল জানান, বিদুতের চোরাই তার বিক্রির জন্য অন্তর তাঁকে একটি পিকআপভ্যান নিয়ে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। পথে পুলিশ থামিয়ে গাড়িটি জব্দ করে এবং চালক আলহাজ ও তাঁকে জেলে পাঠায়। 

ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাজ্জাত হোসেন বলেন, ‘এতিমখানা-সোনারতরী সড়কে বিদ্যুৎ লাইনের খুঁটি স্থাপনে জনপ্রতি ৬ হাজার টাকা চেয়েছিলেন অন্তর। টাকা না পেয়ে দেড় বছর সেই কাজ বন্ধ রাখেন। ওই লাইনে এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ হয়নি।’ একই অভিযোগ করেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শহিদুল ইসলাম। 

সমকালকে তিনি বলেন, ‘এসডিএস মোড়-কমিশনার বাড়ি এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে বছরখানেক আগে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কথা বলে অন্তর ৬০ হাজার টাকা নেন। সেই কাজ এখনও হয়নি, টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না।’ আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল বাছেদ শিকদার বলেন, ‘ঠিকাদারির নামে বিদ্যুতের তার বিক্রি, দালালিসহ নানা অপকর্মের হোতা হয়ে উঠেছেন অন্তর। পরিচালনা করছেন একটি সংঘবদ্ধ চক্র।’

তবে অন্তর আহমেদ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সমকালকে বলেন, ‘দালালি নয়, ঠিকাদারি করি।’ দলের নেতাদের সঙ্গে তোলা সেলফি দেখিয়ে কোথাও কোনো সুবিধা নেননি বলে দাবি করেন তিনি। অন্তর বলেন, ‘সখীপুর বিদ্যুৎ অফিসে আমার কোনো সিন্ডিকেট বা আধিপত্য নেই। কাউকে লাঞ্ছিতও করিনি। কিছু লোক আমার বিরোধিতা করছে।’ 

সখীপুর বিদ্যুৎ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর তালুকদার ঠিকাদার অন্তরের তদবিরে প্রকৌশলী ও কর্মচারীদের বদলি করার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘অন্তরকে আলাদা সুবিধা দেওয়ার কথা সঠিক নয়। ঠিকাদার পরিচয়ধারী কিছু লোক সুবিধা না পেয়ে এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

ঠিকাদার অন্তরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর-বাসাইল) আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম। সমকালকে তিনি বলেন, ‘ছেলেটির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনেক অভিযোগ আমি শুনেছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

আরও পড়ুন

×