ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

গলতে থাকা অ্যান্টার্ক

গলতে থাকা অ্যান্টার্ক

অ্যান্টার্কটিকার দক্ষিণ জর্জিয়া দ্বীপে এখন নগ্ন মাটি আর আগাছার মতো ঘাস গজিয়ে উঠছে

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫ | ০০:০৭ | আপডেট: ১৫ জুন ২০২৫ | ১৭:৫৩

অ্যান্টার্কটিকার জলবায়ু নজিরবিহীন হারে উষ্ণ হয়ে উঠছে। পাতলা হয়ে আসা বরফ আর সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়া যন্ত্রপাতি সামাল দিতে বিজ্ঞানীরা এখন রীতিমতো লড়াই করছেন। 

গত বিশ বছর ধরে সাইমন মর্লি অ্যান্টার্কটিকার সমুদ্র বরফে গর্ত কেটে তাতে ডুব দিয়েছেন। সেখানে পানির নিচের অদ্ভুত আর রঙিন প্রাণীদের, যেমন সামুদ্রিক স্পঞ্জ আর সি স্কোয়াট নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন সেই বরফ এতটাই পাতলা হয়ে পড়ছে যে, তার ওপর দিয়ে চলাফেরা করা আর নিরাপদ থাকছে না।

ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের (বিএএস) সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী মর্লি বলেন, ‘আগে শীতকালে একশ বা তারও বেশি ডাইভ দিতে পারতাম। গত বছর আমার সহকর্মীরা বড়জোর পাঁচ থেকে দশটা ডাইভই দিতে পেরেছেন।’

এখন বরফ এক অদ্ভুত ‘ক্যাচ-২২’ পরিস্থিতি তৈরি করছে। ‘এটি এতটাই পুরু যে নৌকা নামানো যাচ্ছে না, আবার এত পাতলাও নয় যে করাত দিয়ে গর্ত কেটে ডাইভ দেওয়া যাবে,’ তিনি ব্যাখ্যা করেন। তবে তিনি জানান, একটি উপায় হলো– শীতকালে প্রস্তুত নৌকা হাতে রাখা, যাতে বরফ একটু সরে গেলে দ্রুত নামানো যায়।
আমরা সাধারণত অ্যান্টার্কটিকাকে এক চিরবরফাচ্ছন্ন পৃথিবী হিসেবে কল্পনা করি। বাস্তবতা বদলে যাচ্ছে। এখানে বরফের পরিমাণ দ্রুত কমছে, ভূমিতে উদ্ভিদ ছড়িয়ে পড়ছে। বাতাসের তাপমাত্রাও বাড়ছে।

যারা অ্যান্টার্কটিকার পরিবেশ আর সেখানকার প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা করেন, তারা এসব পরিবর্তন স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছেন– কারণ এর প্রভাব সরাসরি তাদের গবেষণার ওপর পড়ছে। ২০০৫ সাল থেকে অ্যান্টার্কটিকায় কাজ করা মর্লি বলেন, ‘যে হিমবাহে আমি স্কি শেখার প্র্যাকটিস করতাম, সেই হিমবাহটা আর নেই, একেবারে উধাও হয়ে গেছে।’ দক্ষিণ জর্জিয়া দ্বীপে এখন নগ্ন মাটি আর আগাছার মতো ঘাস গজিয়ে উঠছে।

অ্যান্টার্কটিকার বরফ বিজ্ঞানীদের কাছে অতীতের জলবায়ুর ইতিহাস জানার এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস। হাজার হাজার বছরের প্রাচীন বরফস্তরের ভেতর থাকা বাতাসের অস্তিত্ব বিশ্লেষণ করে তখনকার তাপমাত্রা আর বায়ুমণ্ডলের গঠন বোঝা যায়। হিমবাহ পিছু হটে ও বরফ গলে যাওয়ায় এই মহামূল্যবান রেকর্ড হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহের জন্য বিজ্ঞানীরা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। 

মর্লি তাঁর দেখা প্রাণীদের স্মরণ করে বলেন, ‘অবিশ্বাস্য স্পঞ্জ, অ্যানিমোনি আর সি স্কোয়াটের বাগান– অসাধারণ। পানির নিচের এই স্বর্গও এখন ঝুঁকির মুখে।’ বরফ কমে যাওয়ার ফলে, ওপর থেকে আলো প্রবেশ করছে বেশি, যার কারণে অ্যালগি বা শৈবালের বিস্তার ঘটছে, তা স্পঞ্জ প্রজাতির জীবদের ঢেকে ফেলছে–বলছেন মর্লি। মে মাসে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা এক গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন, এই প্রাণীরা জলবায়ু পরিবর্তনের আরেক বিপদে পড়েছে– বিশাল বরফের খণ্ড সাগরতলে ধাক্কা দিয়ে এই প্রাণীদের আবাস ধ্বংস করে দিতে পারে যে কোনো সময়।

ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের আরেক গবেষক, বরফ বিশেষজ্ঞ জেরেমি উইলকিনসন জানান, তাঁকেও এখন আর্কটিক অঞ্চলের গবেষণাগুলোর পদ্ধতি পাল্টাতে হয়েছে। আগে তারা বরফের ওপর জলরোধী স্যুটকেস রেখে তাতে বাতাসের গতি ও তাপমাত্রা পরিমাপের যন্ত্র বসিয়ে এক বছরের পর্যবেক্ষণ চালাতেন। এখন বরফ এত দ্রুত গলে যাচ্ছে যে, তারা সেটি আর করতে পারেন না– বরফ গলে যন্ত্রপাতি সাগরে তলিয়ে যায়। তাই এখন তাদের সব যন্ত্র ভেসে থাকার উপযোগী করে তৈরি করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, অ্যান্টার্কটিকায়, দক্ষিণ গোলার্ধের শীতকালেও সমুদ্র বরফের অভাব দেখে চমকে গেছেন নিউজিল্যান্ডের এনআইডব্লিউএ সংস্থার সামুদ্রিক পদার্থবিজ্ঞানী নাটালি রবিনসন। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা উপগ্রহচিত্র ব্যবহার করে ম্যাকমারডো সাউন্ড এলাকায় বরফের গঠন পর্যবেক্ষণ করে বলেন, ‘২০২২ সালে এমন এক বরফ-গঠনের ঋতু পেয়েছিলাম, যা কেউ কোনোদিন দেখেনি। আগস্টের শেষ পর্যন্তও সেখানে পানির ওপরে বরফ জমেনি।’

পরে কিছু বরফ গঠিত হলেও তা এতটাই পাতলা ছিল যে, পরিকল্পিত গবেষণা চালানো যায়নি। মাত্র ১.১ মিটার (৩.৬ ফুট) পুরু বরফ; যা সাধারণ সময়ের অর্ধেকেরও কম– এমন বরফে গাড়ি চালিয়ে পার হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হয়। তাই নিউজিল্যান্ডের দলটি প্রথমবারের মতো যন্ত্রপাতি হেঁটে বহন করে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। রবিনসন বলেন, ‘‘আমরা ওই মৌসুমকে ‘অভূতপূর্ব’ বলেছিলাম; কিন্তু হুবহু একই অবস্থা আবার ২০২৪ সালেও হলো।’’

গত সাত বছর ধরে তিনি বরফের নিচে গঠিত প্লেটলেট আইসের ওপর গবেষণা করতে চেয়েছিলেন–এটি বরফ কণায় পূর্ণ একরকম ঝুলন্ত কাঠামো; যার মাঝে সমুদ্রজল ভরা থাকে। তিনি ও তাঁর দল বিশেষ ধরনের বরফ-কোরিং যন্ত্র তৈরি করেছেন, যাতে এই ভঙ্গুর বরফ সযত্নে তোলা যায় এবং তার গঠন ও প্রাণীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করা যায়।

তাদের মূল লক্ষ্য ছিল রস আইস শেলফের কাছে বরফ সংগ্রহ করা। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তাদের স্কট বেসের কাছাকাছি অঞ্চলে বরফ সংগ্রহ করতে হয়। রবিনসন বলেন, ‘এটি ছিল একেবারেই ভিন্ন এক সাগরের অঞ্চল, যা আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না।’

সমস্যা কেবল বরফ গঠনের অভাবে নয়, দক্ষিণ মহাসাগরে ঝড়ের প্রবণতাও বাড়ছে বলে মনে করছেন তিনি, যা বরফকে স্থিরভাবে জমতে দিচ্ছে না। ঝড়ো বাতাস বাড়ার আরও প্রভাব আছে। তিনি বলেন, ‘এভাবে বাতাস যদি বেশি হয়, তাহলে যেকোনো গবেষণামূলক মাঠপর্যায়ের কাজ অনেক কঠিন হয়ে যাবে।’

গত ২২ বছরে অ্যান্টার্কটিকায় তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে রবিনসন বুঝেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা গভীর। তিনি একে ‘চোখ খুলে দেওয়ার মতো’ বলে বর্ণনা করেন। তবে একটি বিষয়ে তিনি আশান্বিত- মানুষের মনোভাবের পরিবর্তন। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অবিশ্বাস বা অস্বীকৃতি আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এটাই অন্তত আমার জন্য আশাজাগানিয়া।’

সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিছু গবেষণা হয়তো আর ভবিষ্যতে করা সম্ভব হবে না, যদি বিশাল বরফের সমুদ্র চিরতরে হারিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে রবিনসন বলেন, ‘আমরা এখন এই বড় রকমের পরিবর্তনগুলো ঘটার আগে দৌড়ে তথ্য সংগ্রহ করছি।’

বিবিসি’র ক্রিস বারানিউকের প্রতিবেদনের আলোকে

আরও পড়ুন

×