সমকালীন প্রসঙ্গ
কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থা ও জাতীয় সার্বভৌমত্ব

অধ্যাপক ড. মো. এরশাদ হালিম
মো. এরশাদ হালিম
প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২৫ | ১৭:৪২ | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৫ | ০৫:৩২
শিক্ষা অমূল্য এক সম্পদ। এর সঠিক অর্জন ও প্রয়োগ মানবজাতিকে অন্যান্য সব প্রাণিকুল থেকে স্বতন্ত্র এক বৈশিষ্ট্য প্রদান করে। শিক্ষা ব্যতিরেকে কোনো জাতিই প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগোতে পারে না। তাই প্রতিটি রাষ্ট্রের সব জনগণের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা হওয়া উচিত সার্বজনীন। শিক্ষার এতটা গুরুত্বের কারণেই কোনো রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। সুশিক্ষিত একটি জাতিই পারে সরকারকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে। কারণ, তাদের মধ্যে বিরাজ করে সত্যিকারের দেশপ্রেম। ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে রাষ্ট্রীয় বৃহত্তর স্বার্থই তাদের কাছে প্রাধান্য পায়। তারা মাথানত করে না সৃষ্টিকর্তা ব্যতিরেকে অন্য কোনো শক্তির কাছে। নিজস্ব বুদ্ধি-বিবেক প্রয়োগে তারা তাদের সব কাজকর্ম সমাধা করে থাকে। কোনো অশুভ শক্তি কিংবা পঞ্চ রিপু প্রসূত নিজস্ব কোনো হীন স্বার্থ তাদের বিচলিত করতে পারে না। তারা তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনায় অটল থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে।
মূলত সে কারণেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত এ মানুষগুলোকে কিছুটা হলেও সমীহ করে চলে। রাজনৈতিক আগ্রাসনের ক্ষেত্রে এ মানুষগুলোকে নিয়েই তাদের যত দুশ্চিন্তা। তারা সর্বদা স্বশিক্ষিত এই সম্প্রদায়কে বিবেচনা করে নিজেদের মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন মানেই কোনো জাতির মাঝে শক্ত একটি ভিত স্থাপন মাত্র যার ওপর গঠিত উন্নয়ন সমৃদ্ধ সব ধরনের বিনির্মাণ সংশ্লিষ্ট জাতিকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের নিশ্ছিদ্র একটি বেষ্টনীর ভিতরে থেকে এগিয়ে নিতে পারে। জাতির ভাগ্যাকাশে হতে পারে বর্ষণমুখর মেঘের আগমন যার অঝোর ধারায় স্নাত একটি জাতি অবগাহন করতে পারে অপার শান্তি ও সমৃদ্ধির এক সুধা সাগরে।
এ কারণেই মূল শিক্ষার বাইরে রেখে একটি জাতিকে যদি কোনোভাবে মেধাশূন্য করে দেওয়া যায় তবে ওই জাতি অচিরেই হারিয়ে ফেলে তার সৃজনশীলতা ও সঞ্জীবনী শক্তি। ক্ষয় হতে হতে সার্বিক বিবেচনায় দেশটি এক সময় হয়ে পড়ে সম্পূর্ণরূপে দেউলিয়া ও বিদেশনির্ভর। কখনও কখনও রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারকে উচ্চ বেতনে বিদেশি বিশেষজ্ঞগণকে আমদানি করতে হয়। উপযুক্ত মেধা, বুদ্ধি ও দূরদর্শিতার অভাবে দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড পর্যন্ত পরিচালিত হয় বিদেশি বন্ধুদের হীন স্বার্থসংশ্লিষ্ট পরামর্শে। ক্ষমতার অন্ধ মোহে বিবেকবর্জিত ও নতজানু সরকারও অবতীর্ণ হয় ঔপনিবেশিক শাসকের ভূমিকায়। এতে একদিকে রাষ্ট্র হারায় তার অর্জিত রাজস্ব, প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সূচক। অন্যদিকে ফাঁস হয়ে যায় তার অভ্যন্তরীণ সব গোপনীয়তা। তখন রাষ্ট্রীয় দুর্বলতার এই সুযোগটিকে ব্যাটে-বলে কাজে লাগায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। অনেকটাই সহজ হয়ে যায় তাদের পথ চলা। তারা সুনির্দিষ্ট করে নেয় তাদের মিশন ও ভিশন। দিনে দিনে শকুনের কালো থাবা আক্রান্ত রাষ্ট্রগুলোতে এভাবেই বাড়তে থাকে তাদের প্রকাশ্য ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ। আর গায়ে লাগা এই মৌসুমি বাতাসকে যদি বেগবান করতে পারে সাময়িক সুবিধাভোগী দেশীয় কুশীলবগণ তবে তো কথাই নাই। মেধাশূন্য ও দেশপ্রেম বর্জিত জনগণের সরকার এক সময় হয়ে পড়ে চরম অসহায় এবং অবতীর্ণ হয় তাদের মুখ্য ক্রীড়নকের ভূমিকায়। ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনের পথটি অনেকটাই প্রশস্ত হয়ে যায়। শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের মাধ্যমে স্বাধীন, সার্বভৌম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি রাষ্ট্রকে এভাবেই অন্তঃসারশূন্য বানিয়ে অতি সহজেই করে দেওয়া যায় চিরতরে পঙ্গু ও অকার্যকর।
তাই কোনো একটি দেশের শিক্ষা প্রণয়ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ নিয়োগের বেলায় জাতীয় নেতৃবৃন্দকে দেখাতে হয় অনেক বেশি বিচক্ষণতার পরিচয়। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয় এখানে সাম্রাজ্যবাদী কোনো বহিঃরাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসেবে কোনো গোষ্ঠী আছে কিনা যারা উপযাচক হয়ে নিজেদের হীন স্বার্থ সিদ্ধির মাধ্যমে দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে বিদেশি বন্ধুদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিভৃতে অথবা কখনও কখনও প্রকাশ্যে বেহায়ার মতো কাজ করে যাচ্ছে। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের নামে প্রকৃত শিক্ষা ধ্বংস করে আরোপিত অশিক্ষা-কুশিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে কোনোভাবে একটি প্রজন্মকে যদি অথর্ব করে দেওয়া যায় তবে সংশ্লিষ্ট জাতি খুব সহজেই হারিয়ে ফেলে তার উজ্জীবনী শক্তি; যেভাবে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে স্রোত হারিয়ে কীর্তিনাশা পদ্মার মতো একটি নদীও ধাবিত হয় মরুপথে। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা অচল করে দিয়ে আগ্রাসী আঞ্চলিক উদীয়মান পরাশক্তিগুলো এভাবেই ফারাক্কা কিংবা ডুম্বুর বাঁধের মত দেশীয় মানব সম্পদ উন্নয়নের স্রোতকে করে দিচ্ছে শ্লথ। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে যুব সমাজের সুস্থ চিন্তা-চেতনার সলিল সমাধি ঘটাচ্ছে প্রলয়যজ্ঞের এক মহাসমুদ্রে যেভাবে শুকনা মৌসুমে মরা নদীগুলো বাঁধের পানির মাত্রাতিরিক্ত প্রবাহে হয় মহাপ্লাবিত। এর মূল কারণ উপযুক্ত শিক্ষায় মানবসম্পদের সঠিক উন্নয়ন না থাকায় তারা আদতে বুঝতে পারে না কোনটি সংস্কৃতি আর কোনটি অপসংস্কৃতি।
এভাবেই জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রলয়যজ্ঞ ঘটিয়ে স্বাধীনতার ছদ্মাবরণে পশ্চাৎপদ একটি জাতির জনগণকে খুব সহজেই পরাধীনতার শিকলে বন্দি রেখে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রটিকে করা যায় অকার্যকর ও সার্বভৌমত্বহীন। তখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও পররাষ্ট্রনির্ভর সরকার হয়ে পড়ে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের দোসরদের নাচের পুতুল। আর এই পথ ধরেই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হয় হুমকির সম্মুখীন। তথাকথিত অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলমান উন্নয়নের ধারা এগোতে থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। উদীয়মান সার্বভৌমত্ব কিংবা উদিত স্বাধীনতার সূর্য ধাবিত হতে থাকে অস্তাচলের দিকে।
ড. মো. এরশাদ হালিম: অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- শিক্ষা
- সার্বভৌমত্ব